পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে আছে অসাধারণ স্থাপত্য ও নিপুণ শিল্পকর্ম।
এসব স্থাপনা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আগ্রহের কমতি নেই।
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, আর্টেমিসের মন্দির,এথেন্সের অ্যাক্রপলিস, অলিম্পিয়ার গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি ,আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর,মিশরের গ্রেট পিরামিড ইত্যাদি ঐতিহাসিক সপ্তাশ্চর্য গুলোর কথা আমরা সবাই জানি।
প্রাচীনকালে ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস এবং জ্ঞানী ক্যালিম্যাকস আলেকজান্দ্রিয়ার এই ঐতিহাসিক সপ্তাশ্চর্য তালিকা তৈরি করেছিলেন কিন্তু এর যথোপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিশ্বের অসংখ্য স্থাপত্য ও শিল্প কর্মের মধ্যে থেকে, ২০০টি স্থাপনার তালিকা তৈরি করা হয় এবং এর মধ্যে থেকে পৃথিবীর নতুন সাতটি আশ্চর্য বেছে নেয় সুইস সংস্থা নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন।
2000 সালে প্রায় 200 টি স্থাপত্য কে নিয়ে 100 মিলিয়নের বেশি মানুষের দ্বারা ভোট গণনা শুরু হয় এবং 2007 সালে পর্তুগালের রাজধানীর লিসবন শহরে একটি নতুন তালিকা প্রকাশ পায়।
প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য গুলোর মধ্যে থেকে একমাত্র মিশরের পিরামিড কে সাম্মানিক স্থান দেয়া হয়েছে।
সংক্ষিপ্তকারে জেনে নেয়া যাক পৃথিবীর সাত আশ্চর্য হিসেবে বিখ্যাত এসব স্থাপনা নির্মাণের পেছনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
1.মাচু পিচ্চু: (1460-1470) পেরু
মাচু পিচ্চু হ'ল একটি 15 ম শতাব্দীর ইনকা সিটিডেল, এটি দক্ষিণ পেরুর উরুবাবা প্রদেশের মাচুপিচু জেলার কুসকো অঞ্চলে আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব কর্ডিলিরার 2,430-মিটার (7,970 ফুট) উপর অবস্থিত অবস্থিত।
মাচু পিচ্চু নামটি কখনও কখনও "পুরাতন পর্বত" হিসাবে অভিহিত করা হয়।
মাচু পিচ্চু 1450–1460 খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়েছিল,দুই মহান ইনকা শাসক, পাচাকুটেক ইনকা ইউপানকুই এবং টেপাক ইনকা ইউপানকুই এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
অতীতে এখানে উরুম্বা নদী প্রবাহিত হতো।
ইতিহাস থেকে জানতে পারি,গুটি বসন্ত রোগ ছড়িয়ে পড়ায় ইনকারা এই জায়গা পরিত্যাগ করে এবং স্পেনীয়রা ইনকা সাম্রাজ্য কে পরাজিত করার পর 300 বছর এই শহরটি মানুষ সভ্যতা থেকে হারিয়ে যায়।
এটি 1911 সালের আগে পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবী বাসীর কাছে অপরিচিত ছিল।
১৯১১ সালে ইনকা সভ্যতার নিদর্শন মাচু পিচুর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ হিরাম বিংহ্যাম। তিনি এর নাম দেন ইনকাদের হারানো শহর।
মাচু পিচ্চুর আশপাশের ৩২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ১৯৮১ সালে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা ঘোষণা করা হয়।
মাচু পিচ্চুকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে।
2.ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার: রিও ডি জানেইরো, ব্রাজিল
ব্রাজিলের রিও ডি জানেইরো শহরে রয়েছে ১৩০ ফুট উঁচু যীশুখ্রিস্টের বিখ্যাত মূর্তি ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার।
রিও ডি জানেইরো তিজুকা ন্যাশনাল পার্কে করকোভাদো পাহাড়ের চূড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই মূর্তি। ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার ব্রাজিলের ঐতিহাসিক জাতীয় ঐতিহ্য। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে যীশু।
তার এক হাত থেকে অন্য হাতের দূরত্ব ৯২ ফুট। এর মোট ওজন ৬৩৫ মেট্রিক টন। কংক্রিট ও শ্বেতপাথর দিয়ে আলাদাভাবে বিভিন্ন অংশ তৈরি করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে জোড়া দেওয়ার পর দাঁড়িয়েছে বিশালাকার এই মূর্তি।
এই মূর্তিটি দা সিলভা কস্টা নামের এক ব্রাজিলের করার নকশা অনুযায়ী ফরাসি শিল্পী পল ল্যান্ডোস্কি এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন, সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ বছর এবং এর শুভ উদ্বোধন করা হয় 1931 সালের 12 ই অক্টোবর।
এজন্য খরচ হয় ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
3.কলোসিয়াম: রোম, ইতালি
ইতালির রোমের সবচেয়ে বিখ্যাত নির্দশন হলো কলোসিয়াম। বিশ্বের সবচেয়ে সেরা স্তম্ভগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এতে রয়েছে রোমান প্রকৌশলের চোখধাঁধানো নৈপুণ্য।
ইতালির রোম শহরে অবস্থিত একটি বৃহৎ উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন মঞ্চ। ৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই মঞ্চ সাধারণত গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রতিযোগিতা অর্থাৎ মল্লযুদ্ধ এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কোন প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত হত।
এর আদি নাম ছিল ফ্ল্যাভিয়ান নাট্যশালা। ষষ্ঠ শতকের পূর্বে ভূমিকম্প এবং অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এটির পুননির্মাণ ও পরিবর্তন সাধন করা হয়। পরবর্তী শতকগুলোতে কলোসিয়াম অবহেলা, ভূমিকম্প ও এর নির্মাতাদের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বহির্তোরণের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এখনও টিকে আছে।
নিষ্ঠুর সম্রাট টাইটাসের তত্ত্বাবধানে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ইমারতটি মঞ্চনাটক, গ্লাডিয়েটরদের লড়াই, জীবজন্তুর লড়াই ও বিদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য ব্যবহার করা হতো।
রোমের শাসক জুলিয়াস সিজার ৩০০ গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই উপভোগ করেছিলেন। রক্তপিপাসু রোম সম্রাটদের আনন্দের খোরাক জোগাতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে কলোসিয়ামের মাটিতে। লড়াইকারীদের বলা হতো ‘গ্ল্যাডিয়েট’।
হলিউডে রাসেল ক্রো অভিনীত ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ ছবিটি তৈরি হয়েছে এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে।
4.পেত্রা: জর্ডান
পেত্রা একটি প্রাচীন আরব শহর। বর্তমান জর্দানের দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রাম ওয়াদি মুসা-র ঠিক পূর্বে হুর পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এটি ছিল নাবাতাইন রাজ্যের রাজধানী।
জর্ডানের ‘রোজ সিটি’ হিসেবে পরিচিত পেত্রা। চারপাশের গোলাপি মাটির খাড়া বাঁধের জন্যই এই ডাকনাম।
উট, ঘোড়া, গাধার পিঠে চড়ার সুযোগ আছে সেখানে। এছাড়া চা বিক্রেতাদের কেউ কেউ গুহায় চা বিক্রির পাশাপাশি ইংরেজিতে পেত্রার ধ্বংসাবশেষের গল্প শোনায়। জাদুময় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে চাইলে এই শহরের জুড়ি নেই।
পেত্রাকে বলা হয় বিলুপ্ত নগরী।
পেত্রা নগরী মূলত একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। এটি বিখ্যাত এর অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর জন্য। এটি তৈরি হয়েছে গুহার মধ্যে যা কোথাও কোথাও মাত্র ১২ ফুট চওড়া, মাথার ওপরে পাথরের দেয়াল।
গুহার পাশেই রয়েছে কঠিন পাথরের দেয়ালের গায়ে গ্রথিত সেই প্রাচীন দালানগুলো যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দিরটি। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভান্ডার নামেও পরিচিত। আরো রয়েছে একটি অর্ধগোলাকৃতির একটি নাট্যশালা যেখানে প্রায় ৩০০০ দর্শক একসাথে বসতে পারে।
পেত্রা নগরী ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পেত্রার চারধারে ছিল উঁচু পাহাড় আর একটি অফুরন্ত ঝরনাধারা।
পশ্চিমের গাজা, উত্তরের বসরা ও দামাস্কাস, লোহিত সাগরের পাশের আকুয়াবা ও লিউস এবং মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতো পেত্রা।
রোমান শাসনের সময় সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হলে পেত্রা দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে। ১০৬ এডি তে রোমানরা এটিকে দখল করে তাদের ‘আরব পেত্রাইয়া’প্রদেশের অংশীভূত করে।
ইউনেস্কো এটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে ১৯৮৫ সালে।
5.চিচেন ইৎজা: মেক্সিকো
চিচেন ইত্জা প্রাক-কলম্বিয়ান সময়ের মায়া সভ্যতার একটি বড় বিস্ময়নগরী ছিল । এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি মেক্সিকোর ইউকাতান রাজ্যের তিনুম পৌরসভায় অবস্থিত ।
চিচেন ইৎজার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ইৎজার কুয়োর মুখ’।
চিচেন ইৎজার স্থাপত্য ও নিপুণ শিল্পকর্ম দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। এর চারদিকে আছে চমৎকার সিঁড়ি। ওপরে দেখা যায় চৌকো ঘর। বর্তমানে এটি মেক্সিকোর রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
দেশটির ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব ইনস্টিটিউট চিচেন ইৎজার রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
১৯৮৮ সালে চিচেন ইৎজাকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে ইউনেস্কো।
6.তাজমহল: ভারত
বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল। তখন একে বলা হয়েছিল 'বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠকর্ম।'ভারতের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত তাজমহল।
বিশ্বের যেকোনও স্থাপত্যের চেয়ে এর সৌন্দর্য বেশি। পুরোপুরি সাদা মার্বেল দিয়ে বানানো তাজমহল পূর্ণিমার আলোয় মুক্তার মতো ঝলমল করে।
মোগল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মুমতাজের প্রতি ভালোবাসার স্মৃতি হিসেবে এটি নির্মাণ করেন।তাজমহলের উচ্চতা ২১৩ ফুট। এজন্য তখনকার সময়ে ব্যয় হয় ৩ কোটি ২০ লাখ রুপি। ২২ বছর ধরে এটি বানাতে কাজ করেছে ২০ হাজার শ্রমিক।
১৬৪৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এবং এর চারদিকের ইমারত এবং বাগান আরও পাঁচ বছর পরে তৈরি হয়।
নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল আমাদের সবার প্রিয় তাজমহল।
১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তাজমহলকে।
7.গ্রেট ওয়াল অব চায়না: চীন
চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। এই প্রাচীর প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উচু এবং ৮৮৫২ কিলোমিটার লম্বা। এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে।
দেয়ালটিতে নিয়মিত বিরতিতে পর্যবেক্ষণ চৌকি আছে, যা অস্ত্র সংরক্ষণ, সেনাবাহিনীর আবাসন এবং স্মোক সংকেত প্রদানে কাজে লাগত। সেনাঘাটি এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রসমূহ দীর্ঘ বিরতিতে অবস্থিত।
চীনের উত্তর সীমান্তকে মঙ্গোলীয়দের হাত থেকে রক্ষার জন্য খ্রিস্টপূর্ব ২২০-২০৬ সনে চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। অনেকের ধারণা, ১০ লাখ শ্রমিক এতে কাজ করেছিল। তাদের মধ্যে ৩ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। মিং যুগেও এই প্রাচীরের অনেকাংশ নির্মাণ হয়।
১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো এই স্থাপনাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে।
অন্যান্য চূড়ান্ত প্রতিযোগী স্থাপত্যকে বর্ণানুক্রমিক ভাবে দেখানো হলো-
1.এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস, অ্যাথেন্স গ্রীস
2.আলহামব্রা গ্রানাডা, স্পেন
3.আঙ্কোরভাট টেম্পেল, কম্বোডিয়া
4.আইফেল টাওয়ার, প্যারিস, ফ্রান্স
5.হাগিয়া সোফিয়া ইস্তানবুল তুরস্ক
6.কিওমিউজু-ডেরা কিয়োটো জাপান
7.মোয়াই ইস্টার আইল্যান্ড, চিলি
8.নিউসওয়ানস্টেন ফুসেন, জার্মানি
9.রেড স্কয়ার, মস্কো, রাশিয়া
10.স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
11.স্টোনহেঞ্জ আয়াম্স বাড়ি,যুক্তরাজ্য
12.সিডনি অপেরা হাউস, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
13.তিম্বুকতু, মালি
Your email address will not be published. Required fields are marked *