গোটা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৯8 হাজার ছাড়িয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার লক্ষণ নেই। হার্ভার্ডের গবেষকদের আশঙ্কা সত্যি হলে, আগামী শীতে নতুন করে ফিরে আসবে কোভিড-১৯।
এই ক্ষুদ্র দানবের কাছে হারতে বসা শক্তিশালী দেশগুলো যখন দিশেহারা, আশার আলো দেখাচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল থেকে থেকে ভ্যাকসিনের খোঁজে হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করেছে তারা। বিজ্ঞানীদের আশা, ফাইনাল পরীক্ষা’সফল হলে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই মিলে যাবে প্রতিষেধক। গবেষক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন, সারা গিলবার্ট, অ্যান্ড্রু পোলার্ড, স্যান্ডি ডগলাস, টেরেসা ল্যাম্ব এবং অ্যাড্রিয়ান হিল।
বৃহস্পতিবার লন্ডনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক মানবশরীরে করোনার ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেন। সেখানে প্রথমবারের মতো দুজনের দেহে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। যে ব্যক্তির দেহে প্রথম টিকাটি পুশ করা হয় তিনি একজন নারী, নাম এলিসা গ্রানাটো। তিনিও এক জন বিজ্ঞানী। শরীরে এন্টিবডি তৈরি হলে তাকে দেয়া হবে করোনাভাইরাস। ভ্যাকসিন কাজ না করলে মৃত্যুও হতে পারে তার। কোটি কোটি মানুষের জন্য তিনি নিয়েছেন এই ঝুঁকি।
এলিসা গ্রানাটো ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসিকে বলেন,
আমি একজন বিজ্ঞানী। তাই এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটিকে সমর্থন জানাতে নিজে থেকেই এতে অংশ নিতে চেয়েছি।
১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সি ৫১০ জন সুস্থ ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। অক্সফোর্ড ও সাউদাম্পটনে পরীক্ষা চলবে। অংশগ্রহণকারীদের দু’দলে ভাগ করা হয়েছে। এক দলকে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। অন্য দলকে মেনিনজাইটিসের। কাকে কী দেওয়া হচ্ছে, অংশগ্রহণকারীদের জানানো হবে না এবং তাদের নিখুঁতভাবে তাঁদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
মানবদেহে প্রয়োগ করা প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে অক্সফোর্ড বিজ্ঞানীদের গবেষণার নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক সারা গিলবার্ট বলেন, ‘আমি এ ধরনের প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করেছি। মার্সের প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করেছি। এর কী ক্ষমতা তা জানি। এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আমি নিশ্চিত।’ অক্সফোর্ডের তৈরি ভ্যাকসিনটির নাম ‘চ্যাডক্স ১’(ChAdOx1)। এটি একটি ‘অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন’। অ্যাডিনোভাইরাস একটি সাধারণ সর্দি-জ্বরের ভাইরাস, শিম্পাঞ্জিদের থেকে তৈরি। ভাইরাসটিকে ভেক্টর বা বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভেক্টর ভ্যাকসিন হল এমন এক ধরনের প্রতিষেধক, যাতে ক্ষতিকর ভাইরাসটির (সার্স-২ বা কোভিড-১৯) নিউক্লিক অ্যাসিড একটি বাহক মাইক্রোব (অন্য কোনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া)-এর সাহায্যে মানুষের শরীরে প্রবেশ করানো হয়।
বাহক মাইক্রোবটি ভালো, তারা কোনও ক্ষতি করে না। শরীরের মধ্যে ঢুকে তারা খারাপ ভাইরাসটির নিউক্লিক অ্যাসিডের সাহায্যে কিছু প্রয়োজনীয় প্রোটিন (এ ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন) তৈরি করে ফেলে। প্রোটিনগুলোকে দেখে মানুষের শরীর মনে করে ক্ষতিকর ভাইরাসটি হামলা করেছে। সে তৎক্ষণাৎ অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে। রোগ হওয়ার আগেই মানুষের দেহে সে রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এই পদ্ধতিটি বাচ্চা থেকে বয়স্ক, এমনকি অসুস্থদের জন্যেও নিরাপদ বলে দাবি করেছেন অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা।
স্কুলজীবন থেকেই মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক থাকা গিলবার্ট ১৯৯৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ২০০৪ সালে ভ্যাক্সিনোলজির রিডার হিসেবে যোগদান করেন। গিলবার্ট জেন্নার ইনস্টিটিউট এন্ড ন্যুফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে আফ্রিকায় কাঁপিয়েছিলো ইবোলা নামে ভাইরাস। মূলত কঙ্গো অববাহিকায় প্রাদুর্ভাব হওয়া এই মহামারিতে ১৩,৩১০ জন মারা গিয়েছিল। সেবারও এই ভাইরাস রুখতে দিশা দেখিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিজ্ঞানী অধ্যাপক সারা গিলবার্ট।
এবার যখন সারা বিশ্ব মৃত্যুদূত করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে স্তব্ধ, এই রোগ মোকাবিলায় বিশ্বনেতারা দিশেহারা, তখন পৃথিবীকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিচ্ছেন সেই সারা গিলবার্ট।
গবেষক দলের এক সদস্য অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল জানিয়েছেন, বিশ্বের সাতটি জায়গায় এই প্রতিষেধক তৈরির কাজ চলছে। প্রস্তুতকারী অংশীদার হিসেবে রয়েছে ব্রিটেনের তিনটি সংস্থা, ইউরোপের দুটি, চীনের একটি এবং ভারতের একটি সংস্থা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *