বাড়িতে বসে দিন গুণতে কাহাতক আর ভালো লাগে, তাই গত শনিবার 5 ই সেপ্টেম্বর বেরিয়ে পড়েছিলাম বাইক নিয়ে। অনেক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম বাড়ির খুবই কাছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় গরবেতায় রয়েছে এমন এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা যাকে বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলা হয়ে থাকে। গুগল সার্চ করে জেনে নিয়েছিলাম জায়গাটা সম্বন্ধে অল্পবিস্তর তথ্য। তারপর আগের দিন রাতে খাবার বানিয়ে প্যাক করে রাখলাম। আমি বিশ্বাস করি বেড়াতে গেলে শুভস্য শীঘ্রম হওয়া ভীষন জরুরী। তাই ভোর সাড়ে চারটে য় গাড়ি দিলাম স্টার্ট। আমার বাড়ি তারকেশ্বর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর মাত্র 80 কিলোমিটার এর মধ্যে। কিন্তু আপনারা যারা দূর-দূরান্তে থাকো তারাও এখানে আসতে পারো বাই রোড অথবা ট্রেনে করে। সাঁতরাগাছি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পৌঁছে যাবে গরবেতায়। সেখান থেকে টোটো, অটো ভাড়া করে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারবে এখানে।
প্রায় 70 কিলোমিটার গাড়ি চালানোর পর পৌঁছে গেলাম শিলাবতী নদীর বাঁধে। অনেকদিন পরে বেরিয়েছি বাইরে। তাই মন আনন্দে ভরপুর। গুগল ম্যাপস দেখাচ্ছে একটু এগিয়ে নদী পেরিয়ে সামনে গনগনি, আমাদের বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। কিন্তু সর্বনাশ, ব্রিজের কাছে পৌঁছে দেখি জলের তোড়ে ব্রিজ গেছে ভেঙে। সে এক ভয়ানক দৃশ্য। ভাবলেও ভয় লাগে, যখন ব্রিজটা ভেঙেছে তখন যদি কেউ পারাপার করছিল তার অবস্থা ভেবে। কাঠের ব্রিজ জলের চাপে স্রোতের দিকে বেঁকে গেছে। অতঃপর গুগলের আশা ছেড়ে স্থানীয় মানুষজন কে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এখান থেকে প্রায় 15 কিলোমিটার ঘুরে হাই রোড ধরে গরবেতা দিয়ে শিলাবতী ব্রিজ ক্রস করে তবে পৌঁছানো যাবে গনগনি। কি আর করা যায়।
গ্রাম পেরিয়ে উঠলাম হাইওয়েতে। বেশ কিছুক্ষণ পর পৌছালাম শিলাবতী ব্রিজ। ব্রিজে নেমে একটু হাওয়া খেতে নেমেছি, দেখি আর এক সব্বনেশে কান্ড। হাই রোডের ব্রিজের পাশেই ছিল আর একটা ছোট কিন্তু কংক্রিটের ব্রিজ। সেটাও জলের তোড়ে গেছে ভেঙে। নেমে গেলাম সেখানে। নদীতে মাথা ঘুরানো জাল ফেলে মাছ ধরছিল এক কাকু। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম মাত্র গত পরশু দিনে হয়েছে এই ভয়ংকর কান্ড। ইতিমধ্যে সিল করে দেওয়া হয়েছে ব্রিজের এন্ট্রান্স। আমরা পাশ দিয়ে উঠে দেখে এলাম সেই ধ্বংসলীলা। নদীর পাড়ে কাশের মেলা বসেছে।
রাঙ্গামাটির পথ পেরিয়ে আরেকটু এগিয়ে পৌঁছে গেলাম গনগনি। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। প্রকৃতির আপন হাতের ছোঁয়ায় জলের টানে আর হাওয়ার আলিঙ্গনে লাল মাটির পাড় জুড়ে তৈরি হয়েছে এক অপূর্ব শিল্প কর্ম।
প্রায় 70 ফুট উঁচু পাড় ক্ষয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই গনগনি।সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এগিয়ে গেলাম সেই সৌন্দর্যের রস আস্বাদনে। কিন্তু মন খারাপ করে দিল আমাদেরই মত ভ্রমণপিপাসুদের কার্যকলাপ।চারিদিকে পিকনিক করতে এসে ছরিয়ে ছিটিয়ে রেখেছে প্লাস্টিকের কাপ খাবারের প্যাকেট আরো কত কি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা কি প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে হয় না ! সামান্য আমাদের বয়ে আনা প্লাস্টিক যদি আমরা ফেরত না নিয়ে যেতে পারি তাহলেতো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিষিয়ে যাবে পৃথিবী। আমার ভ্রমনপিপাসু বন্ধুরা যারা আজ এই লেখা পড়ছেন, তাদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ। যত পারি আমরা যেন প্লাস্টিক দূষণ কমানোর প্রতি ব্রতী হই।একটু চেষ্টা করলেই আমরা নিজেদের ব্যবহারের প্লাস্টিকের পরিমাণ বহু অংশে কমিয়ে দিতে পারি। তাতে সুন্দর থাকবে আমাদের পৃথিবী। বাঁচবে আরো হাজার হাজার নিরীহ পশুপাখির প্রাণ।
এবার একটা গল্প শোনাই ।আপনারা নিশ্চয়ই মহাভারতে বকাসুরের গল্প শুনে থাকবেন। পঞ্চপান্ডব এবং কুন্তি দেবী এক গ্রামে আসেন এবং জানতে পারেন গ্রামের পাশেই থাকে এক ভয়ঙ্কর দৈত্য।সেই দৈত্তের পেট ভরাতে প্রতিদিন প্রয়োজন হয় একজন জলজ্যান্ত গ্রামবাসীর। তখন কুন্তি দেবীর অনুরোধে ভীম স্বয়ং আসেন এক গ্রামবাসীর পরিবর্তে এবং দিনের পর দিন ব্যাপী এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়। সেই মহাযুদ্ধের ফলে সমগ্র পৃথিবী কাঁপতে থাকে এবং তার ফলেই নাকি সৃষ্টি হয়েছে এই গনগনির।
অবশ্য পুরাণ অনুযায়ী বকাসুরের সাথে ভীমের যুদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে আরো কয়েকটা জায়গা পরিচিত রয়েছে।এ তো গেল পুরাণের কথা। আপনারা যেন আবার এই গল্প বিশ্বাস করবেননা।আসলে কিন্তু ভূমিরূপ সৃষ্টির পিছনে রয়েছে প্রকৃতির লীলা বা বলতে পারেন বিজ্ঞানের খেলা।
শুনলাম বর্ষায় যখন জল বেড়ে দুকুল ছাপিয়ে যায় তখন এই গনগনির ছোট ছোট গুহা জলমগ্ন হয়। আর সে দৃশ্য হয় অসাধারণ। যদিও সেই দৃশ্য চাক্ষুষ করা মহা ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ কদাচিৎই এতটা জল বেড়ে থাকে। লাল পাথরের কারুকার্য পেরিয়ে জলের রেখা ধরে বন আর কাশে র জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে পৌঁছে গেলাম শিলাবতী নদীর কাছে।
ঠান্ডা জলে স্নান সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম পাশের জঙ্গলের পথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক সুন্দর জায়গায় পৌঁছে জঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বসলাম।আমলাগোড়া ফরেস্ট রেঞ্জ এ ভাগ্য ভালো থাকলে হাতির দেখা মেলে। তবে সেটা কি সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য তা আমার জানা নেই। দেখা হলে পরে জানিয়ে দেবো।
টুং টাং করে ভেসে আসছে ঘন্টির আওয়াজ। সাথে মৃদুমন্দ হওয়া। জলের শব্দ। সত্যি বলতে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। হাতির ভয় যদি না থাকতো তাহলে আরামে ঘুম দিয়ে দিতাম।কিন্তু ঘুমালে হয়তো সেই ঘুম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হতে পারে ভেবে ঘুমানো পোস্টপোন করলাম। দুপুরের খাবার সেরে বেরিয়ে এলাম জঙ্গল থেকে।
এখান থেকে মাত্র 30 কিলোমিটার দূরে বিষ্ণুপুর, মল্ল রাজাদের রাজধানী আর বাংলার গর্ব।এবার চললাম সেই রাস্তায়।
কিন্তু হাতে সময় বড় কম, তাই তাড়াহুড়ো করে দেখলাম বিষ্ণুপুরের মন্দির, ঘুমঘর, কামান আরো অনেক কিছু। কিন্তু মন ভরল না। তাই ঠিক করেছি আবার যাবো আর তখন আপনাদের শোনাব বিষ্ণুপুরের ইতিহাস আর তার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা পুরাকীর্তির গল্প। আজকের মত এ পর্যন্তই থাক। আপনাদের সাথে দেখা হচ্ছে আবার আগামী পর্বে।
গনগনির ভ্রমণ ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন-
Your email address will not be published. Required fields are marked *