হাওড়া ব্রিজ পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য গুলির মধ্যে না পড়লেও একে পৃথিবীর একটা আশ্চর্য বলাই চলে। 1765 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর,1850 সালের পর থেকেই হুগলি নদীর দুই পাড়ে প্রচুর কলকারখানা গড়ে উঠতে থাকে, জমে ওঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য। দুই যমজ শহর কলকাতা-হাওড়ার মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যম বলতে জলপথ, তাই ব্রিটিশ সাহেবরা অনুভব করতে থাকেন যে দুই পাড়ের যোগাযোগের জন্য একটা সেতুর প্রয়োজন। সাহেবরা ঠিক করেন যে সেতু নির্মাণ হবে কিন্তু তা সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না, ঠিক করা হয় একটি ট্রাস্টের, নাম দেওয়া হয় "কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট"।
বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলির নকশায়, 1870 সালে 1528 ফুট লম্বা ও 62 ফুট চওড়া পন্টুন ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয়। 1874 সালে এই ব্রিজ তৈরির কাজ শেষ হয়। ঠিক এই বছরই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এই ব্রিজের বেশকিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ভাসমান সেতু সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় জাহাজ ও স্টিমারের জন্য, কারণ জাহাজ গেলে পন্টুন ব্রিজ মাঝখান দিয়ে খুলে দেয়া হতো, ফলে প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হতো। যার ফলে সাহেবরা নতুন ব্রিজের ভাবনা করতে শুরু করলো।
1906 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে প্রধান ইঞ্জিনিয়ার R.S Hayet,John Scott এবং কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার W.V Makev এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। তখনকার জলবায়ু, সুযোগ-সুবিধা বিশ্লেষণ করে, প্রথমেই কমিটি হুগলি নদীর উপর ভাসমান সেতুর বদলে ক্যান্টিলিভার সেতুর সিদ্ধান্ত নেয় ও হাওড়া ব্রিজ তৈরীর সূত্রপাত ঘটে। তবে সূচনাতেই ঘটে প্রচুর বিপত্তি।সেই সময় সমগ্র বিশ্বে ক্যান্টিলিভার সেতুর সংখ্যা ছিল মোট তিনটি। এর মধ্যে ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তিতে তৈরি The Quebec Bridge,Canada ব্রিজ ভেঙে পড়ার ঘটনায় লেসলি সাহেব সহ অনেক ইঞ্জিনিয়ারের ক্যান্টিলিভার সেতু তৈরিতে মত ছিল না। তাছাড়াও তখন কলকাতা বন্দরের কাছে যানবাহন চলাচলের থেকে জাহাজ চলাচলের গুরুত্ব ছিল। বেশি তাই ক্যান্টিলিভার সেতুর থেকে ভাসমান সেতু পাল্লা ভারী হয়ে পড়ে এবং হাওড়া ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব থমকে যায়।
ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এসে পড়ে যুদ্ধের জন্য এদেশে আমদানি কম হতে থাকায় অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়, তাই ব্রিটিশ সরকার নতুন করে কোন কাজ করতে রাজি ছিল না। বেশ কয়েক বছর পর আবার হাওড়া ব্রিজ তৈরির কথা উঠতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার সেই সময় Martin and Co এর মালিক রাজেন্দ্র নাথ মুখার্জী কে সঙ্গে নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্য ছিলেন কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান Climent Hintley, প্রধান ইঞ্জিনিয়ার J. Maglason ও আরেক নামকরা ইঞ্জিনিয়ার Basil Matte। স্যার Basil প্রথম সিঙ্গেল স্প্যান Arched Bridge তৈরীর প্রস্তাব দেন। 1922 সালে আর. এন মুখার্জি কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট দেন, যাতে মূলত ক্যান্টিলিভার সেতু তৈরির সুপারিশ করা হয়। ঠিক হয় সেতুটির উচ্চতা এতটাই হবে যাতে জাহাজ বা স্টিমার অনায়াসেই সেতুর নিচে দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। 1926 সালে The New Howrah Bridge Act পাস হয়। 1930 সালের 15 ই মার্চ হাওড়া ব্রিজ তৈরির জন্য অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন ব্রিটিশ সরকার। সেইমতো 1936 সালে 705 মিটার দীর্ঘ হাওড়া ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয়।
সেই সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সেতুর নকশা তৈরি করেছিলেন Rendel, Pamar and Tritton ত্রয়ী ইঞ্জিনিয়ার। ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেসপ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রায় 25 মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল এই সেতু তৈরিতে। 26500 টন স্টিল ব্যবহার করা হয়েছিল যার মধ্যে 23 হাজার টন টাটা স্টিলের High Tensile Alloy Steel ছিল। নাট বল্টু ছাড়া এই ব্রিজে বর্তমানে প্রতিদিন 3.5 লক্ষ গাড়ি ও প্রায় 5 লাখ পথচারী যাতায়াত করে।
হাওড়া ব্রিজ 1943 সালের তেসরা ফেব্রুয়ারি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়, যার প্রথম যান ছিল কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম। 1965 সালের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে এই ব্রিজের ওফিসিয়াল নাম দেয়া হয় রবীন্দ্র সেতু, যা গেটওয়ে অফ কলকাতা নামেও খ্যাত। বর্তমানে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এর তত্ত্বাবধানে থাকা এই বাঙ্গালীর অহংকার "হাওড়া ব্রিজ" বহু মানুষের যাত্রা সাক্ষী হয়ে আছে ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *