এই বছরটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্ম বর্ষ , তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে লেখকের এই নিবেদন
সৃষ্টির মধ্যেই স্রষ্টা যুগের পর যুগ বেঁচে থাকে ।তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা গবেষণা আজও বহমান। বাঙালির কথামালার বোধোদয় বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই। আমাদের জীবন যাপনের আনাচে-কানাচে যত অন্ধকার তিনি আলোর সারথি হয়ে সেখানে অন্ধকার সরিয়ে প্রজ্বলিত করেছেন জ্ঞানের দীপশিখা। বাংলাদেশের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার প্রসারে , শিক্ষা ও ভাষা পরিকল্পনায় তাঁর নাম আজও স্মরণযোগ্য । ভাঙা-গড়ার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পটভূমিতে তাই বিদ্যাসাগর তার নিজস্বতায় বাঙালির কাছে আদর্শস্থানীয়। 1820 সালের 26 সেপ্টেম্বর থেকে 1891 সালের 29 জুলাই তাঁর এক বর্ণময় জীবন । তাঁর জীবন বর্ণময় হবেই কারণ সেই সময়ে কেবল বিদ্যাসাগর বলে নয়, যে কোন ব্যক্তি এই শতাব্দীর সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়ের মধ্যে দিয়ে তার জীবন পরিচালনা করেছেন, আর ব্যক্তিটি যদি বিদ্যাসাগর হয় তাহলে তো কথাই নেই।
উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ অবশ্যই অবিভক্ত বাংলাদেশ, তার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের আবির্ভাব , ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন , শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে আলোড়ন, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম এবং সব মিলিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দী নিজেই এক রঙিন চরিত্র । তার সহযাত্রী যারা তারা যে বর্ণময় হবেন সে আর বেশি কথা কি ! সাধারণভাবে এই সময় কালকেই বাংলার নবজাগরণ বলা হয় । এসময় একটি তুমুল সামাজিক আলোড়ন হয়েছিল যার ফলে বাংলার সাথে সারা ভারত বর্ষ উপকৃত হয়েছে। সাক্ষরতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে 1846 থেকে 1875 পর্যন্ত বিস্তৃত । তারপরে আরো 16 বছর তিনি বেঁচে ছিলেন।
এখন এই যুক্তিবাদের চর্চায় বিদ্যাসাগরের অবদান আদৌ কি কিছু আছে ?
শব্দটি 'যুক্তিবাদ' হবে কি হবে না এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে । তবে যে অর্থে আলোচনাটি করার চেষ্টা হচ্ছে সেটি বিদ্যাসাগর সমাজ ও জীবন সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন কি না , বিশেষত: তার পরিবর্তনশীল গতি সম্পর্কে । আর এই পরিবর্তন গতির ভিত্তি যেহেতু শিক্ষা- সেই শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তৎকালীন বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছিল কিনা?
অর্থাৎ প্রশ্ন তাঁর শিক্ষার শ্রেণীগত দার্শনিক ভিত্তি বস্তুবাদ নির্ভর না ভাববাদ নির্ভর।
A critique of colonial India বইতে ডক্টর সুমিত সরকার ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মানুষদের 'ভদ্দরলোক' বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন এই সমস্ত লোকদের সাথে সাধারণ মানুষের কোনো রকম জীবন্ত যোগাযোগ ছিল না। যার জন্য 1857 সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম লড়াইতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহীরা কেন অস্ত্র ধারণ করবে সে সম্পর্কে তারা বিস্মিত হয়েছিলেন ।ইংরেজ সরকারের গুনগান বঙ্কিমচন্দ্রও করেছেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময়। ভারতবর্ষে এই পর্যায় অবধি 'জাতীয়তাবোধ' ধারণা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ভারতবর্ষীয় জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি তখনও পর্যন্ত শ্রেণি হিসেবে গড়ে ওঠেনি । প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, এই ভদ্রলোকদের জমি ও তেজারতি ব্যবসার উপর নির্ভরশীলতা , জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী হিসেবে এদের গড়ে উঠতে দেয়নি । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথাটি আরো বেশি করে প্রযোজ্য।
আমাদের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব এই সময়কারই মানুষ । স্বভাবতই তিনি যুগ কে অতিক্রম করতে পারে নি। পারলে শিক্ষাবিদ , করুণাসিন্ধু , শিক্ষার প্রচলক এই নামের পাশাপাশি জন আন্দোলনের নেতৃত্ব হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন । এ তাঁর ত্রুটি নয় এ সময়ের বৈশিষ্ট্য। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন ইংরেজদের দ্বারা এদেশে শিক্ষার প্রসারণ তাদের সাম্রাজ্য ধরে রাখা ও ব্যবসা করার প্রয়োজনেই । কিন্তু তিনি এও বুঝেছিলেন , নারী শিক্ষার বিস্তার ছাড়া সার্বজনীন শিক্ষার বিস্তার সম্ভব নয় । এই শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান বাংলা ভাষাকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা । পরিবর্তনশীল পৃথিবীর খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পাঠক্রম এবং প্রণালীর সুবিন্যাস্ত করন প্রয়োজন । এখানেই তার সম্পর্কে একটি প্রাসঙ্গিক সমালোচনা উপস্থিত করেছেন শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দিন ওমর , বিনয় ঘোষ এবং সৈয়দ শহিদুল্লাহ। ছোটলাট গ্রান্টের কাছে লেখা তাঁর চিঠি ও 'উড ডেসপ্যাচ'- এ প্রস্তাবিত শিক্ষাকর সংক্রান্ত আলোচনা এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করেছেন । সৈয়দ সহিদুল্লাহ মন্তব্য করেছেন 1859 -1860 সালে জমিদারগণ যখন এইভাবে তাদের কার্য সিদ্ধ করলেন তখন বাংলাদেশের নবজাগরণের প্রাতঃস্মরণীয় অনেক মনীষী বেঁচেছিলেন কেউ প্রতিবাদ করলেন না । বদরুদ্দিন ওমর মনে করেন এতে বিদ্যাসাগরের শ্রেণি মনোভাব প্রতিফলিত । কিন্তু বিদ্যাসাগর তার কীর্তিতেই প্রমাণ করেছিলেন তিনি শিক্ষার পক্ষে কিনা। আর বিদ্যাসাগরের শ্রেণী নির্ণয় - এই কাজটি এখনো সম্ভবত হয়নি । বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারক ছিলেন , সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু যুগ কে তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। ঐতিহাসিক তথ্য যা সাক্ষ্য দিচ্ছে তাতে গ্রামের বাড়ির সঙ্গে তার আর্থিক যোগাযোগ ছিল দেওয়ার প্রশ্নে , নেওয়ার প্রশ্ন নয় । অর্থাৎ তিনি জমির উপরনির্ভরশীল নন , যা সেই সময়কার বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন । তাঁর পেশা শিক্ষকতা , স্কুল ইনস্পেক্টার , কলেজের অধ্যাপক , প্রকাশক, সুতরাং শ্রেণী নির্ণয়ের প্রশ্নে বিদ্যাসাগরকে কোথায় ফেলবেন মার্কসীয় অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে তা ভাবতে হবে । মধ্যবিত্তের দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব তার মধ্যে বিরাজমান একথা বোধহয় স্বীকার করতে হবে।
সমাজ জীবনের গতিপথে যা চালিকাশক্তি- তাহল শিক্ষা। এই শিক্ষার বিস্তার ও তৎকালীন সময়ে তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিদ্যাসাগর যা অনুভব করেছিলেন তা বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি সৎ ছিলেন । যুক্তিবাদ গড়ে ওঠা ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটি বড় ধাপ হিসাবে আমরা গ্রহণ করতে পারি।
শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে তার চিন্তা অগ্রসর ধর্মী ও যুক্তিনির্ভর । সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকা কালীন কলেজের পাঠক্রম কী হবে, সেই বিষয়ে তৎকালীন শিক্ষা পরিষদের কাছে পাঠানো তাঁর রিপোর্ট পড়লে তাঁর যুক্তিবাদী অগ্রসর ধর্মী মনোভাব সুস্পষ্ট হবে । তিনি উল্লেখ করেছিলেন বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন এ সম্পর্কে মতবিরোধ নেই , কিন্তু মিথ্যা হলেও হিন্দুদের কাছে এই দুই দর্শন অসাধারণ শ্রদ্ধার জিনিস ছিল । তিনি বলেছিলেন এদের প্রভাব কাটিয়ে তুলতে প্রতিষেধক রূপে ইংরেজিতে ছাত্রদের যথার্থ দর্শন পড়ানো দরকার। বার্কলের Inquiry বেদান্ত ও সাংখ্যর মতোই ইউরোপেও খাঁটি দর্শন বলে বিবেচিত হয় না । বার্কলের ভাববাদী দর্শন এর পরিবর্তে স্টুয়ার্ট মিলের 'লজিক' ও ডেভিড হিউমের 'Treaties' দর্শন শাস্ত্রের বই হিসাবে ঠিক করার্ পিছনে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট।
'Notes on the Sanskrit college' তার হাতে লেখা এই বইয়ে অঙ্ক শিক্ষার গ্রন্থ হিসাবে লীলাবতী ও বীজগণিত বাতিল করেছেন। তার অভিমত সংস্কৃতে গণিত শিক্ষা না দিয়ে ইংরেজিতে গণিত শিক্ষা দেওয়া উচিত ।এ বিষয়ে তাঁর দুটি যুক্তি উপযুক্ত । প্রথমত: এই বইগুলিতে যথেষ্ট উদাহরণ নেই এবং ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রহেলিকা মাত্র । দ্বিতীয়ত: ইউরোপে গণিতের চর্চা ও প্রয়োগ লীলাবতীর যুগ পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে । 1844 সালে তিনি ন্যায় দর্শন পড়াতে আগ্রহী হয়েছিলেন, কারণ তার মধ্যে তর্ক বিদ্যা , আধ্যাত্ম বিদ্যা এবং মধ্যে মধ্যে কিঞ্চিৎ রসায়ন , আলোক বিদ্যা , বলবিদ্যা-র আলোচনা আছে। তাঁর মত অনুযায়ী সমস্ত রকম দর্শন ছাত্রদের পড়া উচিত তাহলে অন্যের মত খণ্ডন করে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হওয়া যায় । তাই আমরা সহজেই বুঝতে পারি এ কোন বিদ্যাসাগর ? যুক্তিবাদী , যুক্তি চর্চায় উৎসাহী , তৎকালীন সময় পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল এবং তার গুনগ্রাহী ছিলেন বিদ্যাসাগর ।যুগের মধ্যে অবস্থান করেও ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পেরেছিলেন । তাই বিদ্যাসাগরের শিক্ষা ভাবনা সেই সময়কার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সবকিছুকে নস্যাৎ না করেও ভাববাদী ছিলনা , যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ট বিশ্লেষণে উৎসাহী ছিলেন। মানবতাবাদ তার মর্ম কেন্দ্রে বিরাজিত ছিল। তাঁর লেখা 'বোধোদয়' বইতে কল্পিত পাঠ অপেক্ষা বাস্তব চেতন পদার্থ মানুষ থেকে শুরু করে জীবজগতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়। সেখানে ঈশ্বর অবহেলিত । এটি পৃথিবী ও তার প্রকৃতি জীবজগৎ ,নদী ,পর্বত, মানব সম্পদ সম্পর্কে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । এজন্য ঊনবিংশ শতাব্দী গর্ব অনুভব করতে পারে । ভবিষ্যতের জন্য বালির নয় কংক্রিটের ধাপ নির্মাণ করেছেন বিদ্যাসাগর। ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন উদাসীন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণ না হলেও মধ্যবিত্তের জ্ঞান ও বুদ্ধি চর্চার জগতে তাদের সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে উজ্জ্বলতম সাফল্য বিদ্যাসাগর । যুক্তিবাদের চর্চার অন্যতম ভিত্তি - শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব হিসাবে বিদ্যাসাগর সফল, যেটুকু ত্রুটি তা তার নয় ত্রুটিটি সময়ের বৈশিষ্ট্য সঞ্জাত । এই বিদ্যাসাগর তাঁতিদের চরকায় বেঁচে আছেন , যুক্তিবাদের মানষেও সমুজ্জ্বল।
(সহায়তা:-পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি দপ্তর দ্বারা প্রকাশিত 'পশ্চিমবঙ্গ' পত্রিকা এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী বিষয়ক অন্যান্য বই ।)
Your email address will not be published. Required fields are marked *
great