ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কিভাবে এ বিষয়ে বলতে গেলে অনেক পেছনে চলে যেতে হয়। বলে রাখা ভাল, ইসরায়েল রাষ্ট্রটি স্বাধীন হয় কোনরুপ যুদ্ধবিগ্রহ করে নয় বরং জাতিসংঘের কন্সটিটিউশন এবং চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, ইহুদিরা আসলে একটি নৃতাত্ত্বিক জাতি। ইহুদিদের আদি নিবাস বর্তমানের সিরিয়া-জর্ডান-লেবানন-ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চল। কিন্তু ইতিহাসের নানা সময় নিপীড়নের শিকার হয়ে ইহুদিরা এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয় এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ ইহুদি বসবাস করত ইউরোপজুড়ে। বিশেষত জার্মান ও রুশ অঞ্চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মানুসারীদের সঙ্গে ইহুদিদের ওপর নতুন নিপীড়ক হিসেবে অবতীর্ণ হয় জাতীয়তাবাদীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইহুদি নেতারা তাদের আদি ভুখন্ডে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এর মূল লক্ষ ছিল ইহুদিরা তাদের আদি ভূখণ্ডে ফিরে যাবে।
১৮৯৬ সালে ডঃ থিওডোর হারজেল প্রথম ইহুদী জাতিগোষ্ঠীর জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। ১৮৯৭ সালে ইহুদিদের আদি নিবাসে ফিরে যাওয়া ও তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির বিষয়টি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ইউরোপের ইহুদীরা গড়ে তোলে জায়ানিস্ট সংঘ। জায়ানিস্ট সংঘ সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইহুদীদের জন্য আলাদা আবাসভূমি এবং যদি সম্ভব হয় তা তাদের আদি নিবাসেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তৎকালীন তুরস্ক থেকে গ্লিসারিন এর বাণিজ্য করত ইউরোপের বনিকেরা যা ইউরোপের সমরাস্ত্র যুদ্ধাস্ত্র এর চালিকাশক্তি বলে বিবেচিত হত, কিন্তু তুরস্কের গ্লিসারিন বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করলে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ বাহিনী। এসময়ই ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হয় ইহুদী বিজ্ঞানী ডঃ ‘কাইম অয়াইজম্যান’। তিনি এসিটোন আবিস্কার করে এর ফর্মুলা ব্রিটিশদের কাছে প্রকাশ করেন যা গ্লিসারিন এর পরিবর্তে সমরাস্ত্র ঠিক রাখার কাজের ব্যাবহৃত হয় এবং বিনিময়ে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইহুদীদের জন্য আলাদা আবাসভূমির দাবি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বর্তমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙ্গে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা,ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর বর্তমান ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন অঞ্চলগুলো ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের ম্যান্ডেটের অধীন চলে যায়। এই সময়েই জায়ানিস্ট সংঘের তৎপরতা বাড়তে থাকে এবং ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিদের আদিভূমি ফিলিস্তিন অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন তীব্রতর হয়। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ।
‘আর্থার জেমস’ বালফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি করেন যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। ব্রিটিশদের এই ঘোষণার কারণ হিসেবে দুইটি বিষয় মানা হয়,একেতো এসিটোন এর ফর্মুলা প্রদান করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অভাবনীয় সাফল্য পায় ব্রিটিশ বাহিনী,সেই সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এবং সেই সাথে ব্রিটিশরা চাইনি ইহুদীদের ইউরোপে জায়গা দিয়ে জঞ্জাল সৃষ্টি করতে। কারণ তারা জানতো ইহুদীরা ঐতিহ্যগতভাবেই ক্ষমতালিপ্সু,বেঈমান জাতি যারপরনাই ইহুদীদের জন্য আলাদা রাস্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা আগ্রহী ছিল।ইহুদীদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। দুর্বল শক্তির কারণে প্রথম পর্যায় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাষ্ট্র সমূহ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমনকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়। ইহুদীরা ফিলিস্তিন আসা শুরু করলে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্ব ইহুদীদের একত্রিত করার কাজ।আরব মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ, তাদের শক্তি খর্ব, তাদের মাঝে অনৈক্য স্থাপন ও আরবশক্তিকে দমনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে ইহুদী অভিবাসীদের ধরে এনে ফিলিস্তিনে জড়ো করার কাজ শুরু করা হয়। ফলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়।ধীরে ধীরে ইসরাইল ইহুদীদের জন্য নিরপরাধ ও স্বাধীন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার ফলে সেখানে ইহুদীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১ সালে ইহুদীদের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায় এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।
১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় গঠিত ইসরাইলের গুপ্ত ইহুদী বাহিনী “হাগানাহ” ইহুদীবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর দায়িত্ব হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর প্রধান কাজ। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি একটি স্বাধীন ও একচ্ছত্র মুসলমানদের এলাকা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিতকরা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ইহুদীদের ক্রীড়নকেপরিণত হয়ে মার্কিন ও ব্রিটেনের চক্রান্তকে সফল করার উদ্দেশ্যে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিরোধিতাকেতোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাব অনুসারে জাতিসংঘ মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের প্রদান করে এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়। এভাবে ফিলিস্তিনের ভূমিকে জোর পূর্বক দখল করে গঠন করা হয় নতুন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৪৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছোট রাষ্ট্রগুলোকে চাপদিতে থাকে জাতিসংঘে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য। মার্কিনদের প্রবল চাপ ও মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনির ম্যানডেট ছেড়ে দেয়। ওই দিনই ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। উপরন্তু প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের একটা বড় অংশ দখল করে ইসরায়েল। সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়।
স্বাধীনতা লাভ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল অস্ত্র-শস্ত্র ও শক্তিতে পরাক্রমশালী হয়ে উঠে। মিত্রদের সহযোগিতা ও আশকারায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরায়েল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিক বনে যায় তারা। দখলদারি ও বর্বরতার ব্যারোমিটার বাড়তে থাকে আর সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরায়েলের একগুঁয়েমি ও নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বইতে থাকে। যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সেই ফিলিস্তিনকে পরাধীনকরে ফিলিস্তিনের বাকি ভূমিগুলোকেও দখলের পায়তারা করতে থাকে ইসরাইল। বিনা অপরাধে, বিনা উস্কানিতে ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো মার্কিনীদের সেবা দাসে পরিণত হওয়ায় তারা ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে খুব বেশি আন্দোলন মুখর হতে ব্যর্থ হয়। ফিলিস্তিনি ভূমি জোর করে দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে চলেছে। আপনি যতক্ষণে এই লেখাটি পড়ে শেষ করবেন ততক্ষনে ফিলিস্তিনে কমপক্ষে একশ বা তার থেকেও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করছে কোন মরণাস্ত্রের আঘাতে।অসংখ্য শিশু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই।অসংখ্য মা সন্তানহারা হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।সেখানে বেচে থাকাই আশ্চর্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনটি যুদ্ধ হয়। এতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান।দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় হামাস। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। কট্টরপন্থী সংগঠনটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *