ভারতে সাপের কামড়ে সবথেকে বেশি মৃত্যুর নেপথ্য রয়েছে এই সাপটিই। ভয়ংকর এই সাপটির বাংলা নাম চন্দ্রবোড়া। তবে রাসেল ভাইপার নামেই বেশি পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii। ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত একটি অন্যতম বিষধর সাপ। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীনের দক্ষিণাংশ, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় এদের দেখা যায়।
পৃথিবীর সব সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে কিন্তু একমাত্র কিলিংমেশিন খ্যাত চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপারের সে বৈশিষ্ট্য নেই। হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে এর অবস্থান প্রথমে। চন্দ্রবোড়া আক্রমণের ক্ষেত্রে এতই ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের ভেতরে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে।
বৈশিষ্ট্য :
১. ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র হিমোটক্সিক সাপ।
২. ফণাহীন সাপ। এরা একেবারে সামনে থেকে মাথা উঁচু করে কামড় বসায়।
৩. এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে।
৪. এ সাপের দেহ অনেক মোটাসোটা। লেজ ছোট ও সরু।
৫. প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত চার ফুটের বেশি হয় না।
৬. বাদামি বা কাঠ রঙের,গায়ে চন্দন হলুদ চাকা চাকা দাগ থাকে৷ দেখতে অনেকটা অজগরের মত।
৭. এদের ত্রিকোণাকার মাথা এমনি দেখলে মনে হয় শরীর থেকে আলাদা।
৮. এরা নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত জায়গায় কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে, এরা শুকনা গাছের গুড়ি, ডাব গাছের নিচে, খড়ের গাদায় থাকতে খুব পছন্দ করে, সাধারণত খড়ের রংয়ের সঙ্গে এদের বোঝা যায় না তাই মানুষ যখন খড়ের গাদা থেকে ঘর বার করতে যায় তখন এরা কামর দিয়ে বসে।
৯. অন্যান্য সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে কিন্তু হিংস্র রাসেল ভাইপারের শিকারকে শুধু একা নয়, তার পুরো পরিবারসহ খেতে ভালোবাসে। তাই অন্যান্য সাপ যেমন একটি ইঁদুরকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে, রাসেল ভাইপার সে ক্ষেত্রে কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড বিষের যন্ত্রণায় ইঁদুর যখন তার গর্তের দিকে ছুটে চলে রাসেল ভাইপার তার পিছু পিছু গিয়ে সে গর্তে ঢুকে সব ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে।
১০. চন্দ্রবোড়া বংশ বিস্তার করে খুব দ্রুত। চন্দ্রবোড়া বছরের যেকোনো সময় প্রজননে লিপ্ত হয়, এরা ডিম পারে না এরা সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। এরা একসঙ্গে ৫০ থেকে ৮০ টি বাচ্চা প্রসব করতে পারে।
এর দংশনে কি হয়?
রাসেল ভাইপারের কামড়ে দংশন স্থান ফুলে ওঠে, প্রচন্ড জ্বালার সৃষ্টি হয়। এদের কামড়ে প্রতি প্রথম ১০০ মিনিট পর থেকে এক পারসেন্ট কিডনি বিকল হতে থাকে। এদের কামড়ে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটে, রক্ত জমাট বাধেনা। মানুষের শরীরে বিভিন্ন ফুটো দিয়ে যেমন নাক, কান, মুখ,মুত্র ছিদ্র, পায়ুছিদ্র যে কোন জায়গা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে থাকে। সাপটির বিষক্রিয়ায় অত্যাধিক রক্তক্ষরণ ঘটে এবং অনেক যন্ত্রণার পর মৃত্য হতে পারে। এদের কামড়ে ডায়ালিসিস বাধ্যতামূলক, এদের বিষ কিডনিকে বিকল করে দিতে থাকে। এদের বিষ এতটাই তীব্র যে ক্ষতস্থানের মাংসে পচন শুরু হয় এবং হাড় থেকে মাংস আলাদা হতে থাকে, বেশিরভাগ রোগী হসপিটালে সুস্থ হয়ে গেলেও পরে বাড়িতে ফিরে মারা যায়।
আবারও বলি সাপ খুব নিরীহ, শান্ত প্রজাতির প্রাণী। এরা মানুষকে কামড়াতে চায়না, এরা বিরক্ত বোধ করলে বা ভয় পেয়ে মানুষকে কামড়ে দেয়। তাই সাপ মারবেন না, সাপ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই জরুরী। এমনকি সাপের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও খুব জরুরী। পশ্চিমবঙ্গে এন্টিভেনম তৈরি হয় না, কারণ এখানে সাপ ধরা আইনত নিষিদ্ধ। তাই তামিলনাড়ু থেকে এন্টিভেনাম আমদানি করতে হয়। সর্প বিশারদরা বলছেন, তামিলনাড়ুতে চন্দ্রবোড়া সাপের বিষ দিয়ে যে এন্টিভেনম তৈরি হচ্ছে, তা এ রাজ্যের চন্দ্রবোড়া সাপের কামড় খাওয়া রোগীর শরীরে কাজ করছে না। কারণ অঞ্চল ভেদে একই প্রজাতির সাপের বিষে তারতম্য ঘটে, তাই স্থানীয় এলাকা থেকে সাপ ধরে সেই বিষ দিয়ে এন্টিভেনম তৈরি করতে হবে। তবেই পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্রবোড়া সাপে কাটা রোগীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব।
Your email address will not be published. Required fields are marked *