মহামানব রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। বাংলার বিস্ময় রবীন্দ্রনাথ। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ স্মরণীয় পূজনীয় কর্মবীর রবীন্দ্রনাথ। বাঙালিসত্ত্বার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ।
কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত।
১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এশিয়ার বিদগ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে ব্যবসায়ের সূত্রে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের চেষ্টায় এ বংশের জমিদারি এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায়। ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে লালিত এবং আত্মপ্রতিষ্ঠিত দ্বারকানাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি জনহিতকর কাজেও সাফল্য অর্জন করেন। উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণ এবং ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। এ যুগের অন্যতম সমাজ-সংস্কারক এবং একেশ্বরবাদের প্রবক্তা রামমোহন রায় ছিলেন দ্বারকানাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রামমোহন রায়ের আদর্শ দ্বারকানাথ, তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ এবং দৌহিত্র রবীন্দ্রনাথের ওপর এক অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু কলেজে শিক্ষালাভ করেন। দ্বারকানাথ যখন ব্যবসায় এবং জমিদারি পরিচালনায় ব্যাপৃত, সে সময় পুত্র দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে সঞ্চারিত হয় আধ্যাত্মিক চেতনা। ঈশ্বর-ব্যাকুলতায় তিনি ইউরোপীয় ও ভারতীয় দর্শনের প্রতি নিবিষ্ট হন। অবশেষে উপনিষদ চর্চার মাধ্যমে তাঁর আত্মা স্থিত হয় এবং এক বিশুদ্ধ সত্যের উপলব্ধিতে তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে আত্মপ্রত্যয়। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন জাগতিক বিষয়ে নিষ্ঠাবান অথচ নিরাসক্ত, প্রখর যুক্তিবাদী কিন্তু হূদয়বান। দেবেন্দ্রনাথের এই বৈশিষ্ট্যই আকৃষ্ট করে পুত্র রবীন্দ্রনাথকে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতামাতার ১৫ জন ছেলে মেয়ের মধ্যে চতুর্দশ সন্তান। রবীন্দ্রনাথ সুস্থ-সবল ও দীর্ঘায়ু সম্পন্ন হলেও তাঁর অনেক ভাই-ই ছিলেন অসুস্থ, মস্তিস্ক বিকৃত ও স্বল্পায়ুর অধিকারী। দেশভ্রমণের নেশায় রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তর ভারত, ইংল্যান্ডসহ বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে কাটাতেন। এ কারণে তিনি জীবনের প্রথম দশটি বছর পিতার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাননি। ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নিলেও পিতামাতার ভালোবাসায় অতিবাহিত হয়নি তাঁর শৈশব। তাইতো ভৃত্যদের কড়া অনুশাসনে কাটাতে হয়েছিল ছেলেবেলা। রবীন্দ্রনাথসহ অন্য সব শিশু-বালকের দিন কাটত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বাইরে দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে।
রবীন্দ্রনাথের ভাইবোনেরা তাঁকে আদর করে রবি বলে ডাকতেন। উজ্জ্বল বর্ণের শিশুদের সবাই একটু বেশিই পছন্দ করে। এটা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্যান্য সহোদরদের তুলনায় অতটা উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী ছিলেন না। তাঁর বড় দিদি সৌদামিনী দেবী তাঁকে উদ্দেশ্য করে প্রায়ই বলতেন, আমার রবি শ্যাম বর্ণের হতে পারে, কিন্তু জ্ঞান-গরিমার উজ্জ্বলতায় সে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। পরে বেশ কয়েক বছর তিনি পড়েন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত নর্মাল স্কুলে। সেখানেই তাঁর বাংলা শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হয়। সবশেষে তাঁকে ভর্তি করা হয় সেন্ট জেভিয়ার্সে। কিন্তু অনিয়মিত উপস্থিতির জন্য তাঁর স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে গৃহশিক্ষকের নিকট বাড়িতে বসে তাঁকে পড়তে হয় সংস্কৃত, ইংরেজি সাহিত্য, পদার্থবিদ্যা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, প্রাকৃতবিজ্ঞান প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘অভিলাষ’ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
দেশের প্রচলিত শিক্ষাধারার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনাগ্রহ দেখে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সতেরো বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড যান। সেখানে কিছুদিন ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে এবং পরে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। তবে এ পড়াও সম্পূর্ণ হয়নি। দেড় বছর অবস্থানের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। এখানেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৯০৫ সালে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে।
১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি প্রদান করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন। ১৯২৩ সালে শান্তিনিকেতনেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে 13 টি উপন্যাস, 36 টি প্রবন্ধ, 95 টি ছোটগল্প, 52 টি কাব্যগ্রন্থ, 38 টি নাটক লিখেছিলেন। বাংলা ভাষার উচ্চশিক্ষা এই কলেজ না যাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত রচনার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *