বর্তমান সময়ে পরিবেশ দুষণের জন্য যে সব কারণগুলি দায়ী তাদের মধ্যে প্লাসটিক-দূষণ সারা বিশ্বের কাছে মাথা ব্যথার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি গবেষণায় জানা গেছে যে, বিগত দু’দশকে প্লাসটিকের ব্যবহার চূড়ান্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্লাসটিকজাত দ্রব্য তৈরির কারখানার সংখ্যাও দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। আর আমরা যত বেশী প্লাসটিকজাত দ্রব্য ব্যবহার করছি, তত বেশী প্লাসটিক বর্জ্য আমাদের এই গ্রহে জমা হচ্ছে । আমাদের আশেপাশে যে দিকেই তাকাই না কেন - রাস্তা-ঘাট, পুকুর-ডােবা, খাল-বিল, নালা-নর্দমা, ঝােপ-ঝাড়, নদী-সমুদ্র এমনকি আমাদের বাসস্থান এবং বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ - সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই অসংখ্য রং-বেরংয়ের প্লাসটিকের প্যাকেট পড়ে রয়েছে। তাই প্লাসটিক দূষণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়ানক বিপদ সংকেত জ্ঞাপন করছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
১) বেশীরভাগ প্লাসটিক জীববিয়ােজনযােগ্য নয় (non-biodegradable) । জীববিয়ােজনযােগ্য না হওয়ার কারণে মাটিতে বা জলে কোনাে জীবাণু বা ব্যাকটিরিয়ার দ্বারা বিয়ােজিত হয় না। তাই প্লাসটিকজাত দ্রব্য শতশত বৎসর অবিয়ােজিত অবস্থায় পরিবেশের মধ্যে থেকে যায় এবং মাটি, জল ও বাতাসকে দুষিত করে চলে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, একটি প্লাসটিকের ঢাকনা প্রায় ৫০ বছর, তরল পানীয়ের বােতল প্রায় ৪০০ বছর এবং মাছ ধরা জালের সুতাে প্রায় ৬০০ বছর পরিবেশের মধ্যে অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়।
২) প্লাসটিক ভেঙে গুড়াে হয়ে গেলেও বিয়ােজিত হয় না। এই অবিয়ােজিত প্লাসটিক-চুর্ণ সহজেই মাটি, জল ও বাতাসে মিশে যায়। জলাশয়ে (পুকুর-নদী-সমুদ্র) প্লাসটিক মাছের শরীরে প্রবেশ করে। সেই মাছ খেলে মানুষও প্লাসটিক দূষণে আক্রান্ত হয়।
৩) প্লাসটিক হালকা অথচ দৃঢ়, জলে ভেজে না, সহজে বিভিন্ন আকর্ষণীয় রঙে এবং আকৃতিতে ঢালাই করা যায়, সর্বোপরি দামে সস্তা। তাই প্লাসটিকজাত দ্রব্য – যেমন, জলের বােতল, চুপড়ি, ঝুড়ি, চেয়ার, টেবিল, তাক, শিশুদের খেলনা, পঠন-পাঠন সামগ্রি এবং ক্যারি-ব্যাগ ইত্যাদির ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এরই ফলশ্রুতি, চতুর্দিকে প্লাসটিকজাত বর্জ্য পদার্থের পরিমাণও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪) প্রাসটিকের সর্বব্যাপী ব্যবহার সত্ত্বেও এর কুফল অর্থাৎ, পরিবেশ (মাটি, জল ও বায়ু) এবং জীবদেহ তথা মানব শরীরে এর প্রভাব সম্পর্কে বেশীরভাগ মানুষের উদাসীনতা এবং অজ্ঞতার জন্য এর ব্যাবহারের উপর আমাদের এখনো পর্যন্ত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধিকাংশ দেশের সরকারেরও প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তেমন কোনাে ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষকরা যাচ্ছে না। ফলে সমস্যাটি ক্রমশঃ অশনি সংকেতের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
প্লাসটিকে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়ণিক পদার্থ:- ব্যবহারােপযােগী প্লাসটিককে আকর্ষণীয় ও নমনীয় (মানােন্নয়ন) করার জন্য এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের বিষাক্ত (Toxic) রাসায়নিক পদার্থ মেশানাে হয় । পরে পরিত্যক্ত প্লাসটিকজাত বর্জ্য থেকে ওই সব রাসায়নিক পদার্থগুলি পরিবেশে মুক্ত হয় যা বিভিন্ন ভাবে (শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য ও পানীয় এবং ত্বকের দ্বারা শােষিত হয়ে) আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং বিষক্রিয়া ঘটায়। প্লাসটিকে উপস্থিত প্রধান তিনটি Toxic পদার্থ হল-
(১) Bisphenol A (BPA) : এটি মূলত খাদ্য ও পানীয় সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত প্লাসটিকের বােতল, জার, টিফিন বাক্স ইত্যাদি উৎপাদনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এণ্ডোক্রিন গ্রন্থির উপর এর বিশেষ খারাপ প্রভাব আছে। তবে আশার কথা হল, মানব স্বাস্থ্যের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের কথা বিচার করে ইউরােপীয় ইউনিয়ন (EU) BPA' র ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
(২) Plasticisers : এটি PVC কে অধিকতর নমনীয় করতে ব্যবহৃত হয়। জলের পাইপ, বাচ্চাদের খেলনা, গাড়ির সীট - প্রভৃতি প্রস্তুত করতে PVC ব্যবহৃত হয়।
(৩) Flame retardants (অগ্নি নিরোধক ) : বৈদ্যুতিন (Electronics) যন্ত্রপাতি,বৈদ্যুতিক (Elec- tric) তারের আচ্ছাদন (Cover) প্রস্তুতিতে অগ্নি নিরােধক প্লাসটিক ব্যবহৃত হয়। এর ক্ষতিকর দিকের কথা বিচার করে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations) এর ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকরী হয়েছে সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।
১) জলের বােতল : এখন পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ প্লাসটিকের বােতলে জল পান করেন। আবার পানীয় জল সংরক্ষণের জন্য প্লাসটিকের মগ ও কলসীও ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৮ সালে WHO এর এক গবেষণায় জানা গেছে যে, প্রায় ৯০ শতাংশ পানীয় জলের বােতলে প্লাসটিক কণার (micro plastic) অস্তিত্ব আছে। এই প্লাসটিক পানীয় জলের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। এটি খুবই আশংকার কথা।
২) প্যাকেজিং : খাদ্য (বিস্কুট, চীপস ইত্যাদি) পানীয় ও ঔষধ সংরক্ষণে যে প্লাসটিক ব্যবহৃত হয়। তাতে অশুদ্ধি হিসাবে BPA মেশানাে থাকে যা সহজেই ওই খাদ্য বা, পানীয়ের দ্বারা শােষিত হয়। এবং আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
৩) পোষাক পরিচ্ছদ : The Global Apparel Fiber Consumption এর গবেষণায় জানা গেছে যে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ব্যবহৃত একলক্ষ কেজি তন্তুর মধ্যে ৭০ শতাংশই হল সংশ্লেষিত তন্তু (Synthetic Fiber) যেমন, Polyester, Acrylic, Rayon, Nylon ইত্যাদি । পেট্রোলিয়াম থেকে উপজাত হিসাবে পাওয়া যায় এবং এরাও একপ্রকার প্রাসটিক । এইসব তন্তুজ পােষাক-পরিচ্ছদ থেকে সততই প্লাসটিক কণা (micro plastic) বাতাসে নির্গত হয় এবং আমাদের ত্বক ও শ্বাস ক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া এইসব পােশাক ঘাম শোষণ করে না বলে ঘর্মাক্ত ত্বকে বিভিন্ন ব্যাকটিরিয়া প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। আবার এইসব কৃত্রিম তন্তুর পােশাক কাচাকাটির সময় প্রচুর প্লাসটিক কণা জলে মিশে জলকেও দূষিত করে।
৪) প্লাসটিকে শ্বাস গ্রহণ : আমাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে আমরা অনেক সময় আমরা অনেক সময় খােলা জায়গায় পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের জঞ্জালে আগুন ধরিয়ে দিই। এর ফলে প্লাস্টিকে উপস্থিত ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থগুলি বায়ুতে মিশে যায় এবং প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষ এই বিষক্রিয়ার ফলে মারা যায়।
প্লাসটিক কণার সাইজ ২-৫ মিলিমিটার হলে সেগুলিকে micro plastic বলা হয়। প্লাসটিক ব্যাগ ও খাদ্যাধার (Food container) থেকে এই micro plastic উৎপন্ন হয়। এতে বিষাক্ত - BPA, DDT, PCB - ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা পরিবেশকে দূষিত করে এবং আমাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায়। ২০ মিলিমিটার অপেক্ষা বড় প্লাসটিকের টুকরােকে macro plastic বলে। মাছধরা জালের সুতো, Pastic carry bag প্রভৃতি থেকে এগুলি উৎপন্ন হয়।
2008 সালে University of Plymouth, UK'র গবেষক Richard Thompson এবং তার সহকর্মীগণের সমীক্ষায় জানা গেছে যে, ইউরােপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্রতট বিপুল পরিমাণ micro-plastic দূষণে দূষিত। ওনারা অনুমান করেছেন যে, প্রতি বর্গকিমি সমুদ্রে প্রায় তিনলক্ষ (৩০০০০০) প্লাসটিকের দ্রব্য এবং একলক্ষ (১০০০০০) প্লাসটিকের টুকরাে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তন :- ২০১৯ - র এক রিপাের্টে বলা হয়েছে যে, চলতি বর্ষে জীবাশ্ম জ্বালানি, ফাইটোপ্লাঙ্কটন এবং প্লাসটিক বর্জ্য থেকে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে নির্গত হবে। পরিস্থিতির বদল না ঘটালে এই নির্গমনের পরিমাণ ২০৩০ সালে হবে প্রায় ১.৩৪ বিলিয়ন টন এবং ২০৫০ সালে হবে প্রায় ৫৬ বিলিয়ন টন। আমরা জানি, বিশ্ব উষ্ণায়ণের জন্য প্রধানত দায়ী হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড। ফলত গ্রীণ হাউস এফেক্ট তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রবল হবে এবং যার ফলশ্রুতিতে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে।
স্থল ভূমির উপর প্রভাব :- স্থল ভূমির উপর প্লাসটিক দূষণ জীবজগতের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ভূ-ভাগে প্লাসটিক দূষণের মাত্রা সমুদ্রের তুলনায় প্রায় ৪ – ২৩ গুণ। জলে যে পরিমাণ প্লাসটিকজাত দ্রব্য ফেলা হয় তার থেকে বহুগুণ বেশী মাটিতে মেশে বলে একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে। নিরাপদ প্রক্রিয়াকরণ হয়নি এমন প্লাসটিক দূষণের মাত্রা সারা পৃথিবীর মধ্যে পূর্ব এশিয়াতেই ৬০% এবং ১% উত্তর আমেরেকায়। স্থলভূমির এই প্লাসটিক বর্জ্য আবার বিভিন্নভাবে জলবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মেশে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিবছর এইরকম অ-প্রক্রিয়াজাত প্লাসটিক বর্জ্যের এক তৃতীয়াংশ থেকে প্রায় অর্ধেক সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।
ক্লোরিনযুক্ত প্লাসটিক বর্জ্য অত্যন্ত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে যা ক্রমে ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরে গিয়ে পৌঁছায় এবং ভূ-পৃষ্ঠস্থ অন্যান্য জলাশয়ের জলের সঙ্গেও মেশে। ফলে বাস্তুতন্ত্রের (Eco-System) উপর অত্যন্ত কু-প্রভাব পড়ে। এই ধরণের বিষাক্ত জল পান করলে জীবজগতের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
এছাড়া কৃষি জমিতে প্লাসটিকজাত আবর্জনা মিশলে তা অনুর্বর হয়ে পড়ে, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। জল নিকাশি নালা আটকে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, মশা-মাছির উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টির জল এই বর্জ্য পলিথিনে আটকে গিয়ে ভূ-গর্ভে পৌছাতে পারে না, অধিকাংশ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরের RE-FILLING ব্যাহত হয়।
Tap-water-এর উপর প্রভাব :- ২০১৭ সালের এক গবেষণায় জানা গেছে যে, বিশ্বব্যাপী ৮৩% ট্যাপ -ওয়াটার প্লাস্টিক দূষণে দূষিত। এর মধ্যে আমেরিকার ৯৪% ট্যাপ-ওয়াটার প্লাস্টিক দূষণের কবলে পড়েছে । এর পরেই আছে লেবানন ও আমাদের ভারতবর্ষ। এল্যাণ্ড, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে ট্যাপ-ওয়ারটারে প্লাসটিক দূষণের মাত্রা তুলনায় কম হলেও ৭২% এর নীচে নয়। এর অর্থই হল প্রতিবছর মানুষ বিপজ্জনক পরিমাণ (3000-4000 micro plastics) প্লাসটিক কণা ট্যাপের জলের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করাচ্ছে। গবেষণা সাপেক্ষ হলেও বিজ্ঞানীদের মতে মানব শরীরে এই প্লাস্টিক দূষণ বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতেই পারে।
সমুদ্রের উপর প্রভাব:- ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মহাসাগরগুলিতে প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাসটিক বর্জ্য পরিত্যক্ত হয়েছে। The Ocean Conservancy জানিয়েছে যে, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যাণ্ড সবচেয়ে বেশী পরিমাণ প্লাসটিক বর্জ সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন টনেরও বেশী প্লাসটিকজাত বর্জ্য সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই সমস্ত প্লাসটিক বর্জ্য থেকে নির্গত বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রের জলে মিশছে এবং সেখান থেকে মাছের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এইসব বিষাক্ত পদার্থের মধ্যে যেমন লেড, মার্কারি ও ক্যাডমিয়ামের মতো বিষাক্ত ভারি ধাতু আছে তেমনি Diethlhexy Phthalate (DEHP) এর মতাে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বিষাক্ত রাসায়নিক আছে। এইসব বিষাক্ত পদার্থ সম্পৃক্ত সামুদ্রিক মাছ খেলে ক্যান্সার, অনাক্রম্যতা ও জন্মগত সমস্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
প্রাণি জগতের উপর প্রভাব:- প্লাস্টিক দূষণ প্রাণিজগতের উপর যে ধরণের মারাক্ষতক প্রভাব সৃষ্টি করেছে তাতে আমাদের খাদ্য সম্পদও আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে হানিকারক হয়ে উঠছে। সামুদ্রিক কচ্ছপের পাকস্থলীতে প্লাস্টিক অস্তিত্ব ধরা পড়েছে যা তাদের পাচন নালিকে বন্ধ করে দিয়ে তাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া সমুদ্রে পরিত্যক্ত মাছধরা জালে আটকে পড়ে কচ্ছপ, মাছ, সীল, সামুদ্রিক পাখি প্রভৃতি বহু সামুদ্রিক জীবের মৃত্যু ঘটছে। ২০০৬ সালে 'Plastic Debris in the World's Ocean' রিপাের্টে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রায় ২৬৭ ধরণের বিভিন্ন প্রাণি প্রজাতি এই প্লাসটিক দূষণে আক্রান্ত। এছাড়া মাছধরা জালের ঘর্ষণে প্রবালেরও মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। ১৯৭০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তীরে ভেসে আসা বেশ কয়েকটি মৃত তিমির পাকস্থলিতে প্রচুর পরিমাণে প্লাসটিকের উপস্থিতি দেখা গেছে। World Wild-Life Foundation-সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষেত্রে প্লাসটিক দূষণকে অত্যন্ত মারাত্মক বলে সতর্কতা জারি করেছে।
প্লাসটিক দূষণ থেকে কেবল সামুদ্রিক প্রাণিরাই নয়, সামুদ্রিক পাখিরাও রেহাই পয় নি। বিভিন্ন সামুদ্রিক মৃত পাখির পাকস্থলিতেও প্লাস্টিকের অস্তিত্ব দেখা গেছে। প্লাস্টিক ভক্ষণের ফলে পাখিদের অপুষ্টি, পাচন ক্ষমতা হ্রাস, আহারে অনীহা, বন্ধাত্ব এবং চরম পরিণতিতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে। প্লাস্টিক থেকে নির্গত Polychlorinated Biphenyl (PCB) প্রজনন ক্ষমতা, অনাক্রমতা এবং শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
বিশেষ এক প্রজাতির Albatros (Laysan Albatros) এর প্রায় ১.৫ মিলিয়নের পাকস্থলিতে প্লাসটিকের উপস্থিতি আছে বলে মনে করা হচ্ছে যা তাদের হজম ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিয়ে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। এইসব পাখিরা লাল, গোলাপি, বাদামী ও নীল রঙের প্রাসটিকের টুকরােকে স্বাভাবিক খাবার মনে করে খেয়ে ফেলে । এছাড়া Plasticiser ও BPA - দূষণের জন্য জলজ প্রাণীদের (মাছ-ব্যাঙ) ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়া এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ওজন কমে যায়।
মনুষ্য জগতের উপর প্রভাব (Effects on Mankind) :- আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যে, প্লাসটিক উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বাতাস ও জলে মিশে পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে । যেমন Phthalates, Bisphenol-A (BPA), Poly Brominated Diphenyl Ether (PBDE) প্রভৃতি রাসায়নিক ক্ষতিকারক জেনেও খাদ্যবস্তু প্যাকেজিং, চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি (ট্যাবলেট প্যাকেজিং, সিরিঞ্জ তৈরি ইত্যাদি), মেঝের কভার, পানীয় জলের বােতল, সুগন্ধি দ্রব্য ও প্রসাধনী দ্রব্য প্রভৃতি প্রস্তুতিতে এগুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এইসব বিষাক্ত (Toxic) রাসায়নিক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন PBD থাইরয়েড হরমােনের উপর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব বিস্তার করে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। BPA এণ্ডোক্রিন তন্ত্রের কার্যকারিতায় বিঘ্ন উৎপাদন করে। এণ্ডোক্রিন তন্ত্র যেসব শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করে সেগুলি হল- (1) Metabolism (2) Heart rate (3) Digestion (4) Body Temperature (5) Gen eral Mood (6) Ability to Sleepwell (7) Sexual Function (8) Fertility & Reproduction (9) Tissue Development & Function (10) Insulin Secretion & Sugar Control.
সুতরাং বােঝাই যাচ্ছে যে, এন্ডোক্রিন তন্ত্রের কাজ ব্যাহত হলে আমরা কী কী সমস্যায় পড়তে পারি। এছাড়াও অন্যান্য যে সমস্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে সেগুলি হল - (1) Osteoporesis (2) Thyroid Cancer (3) Hypo & Hyper-tension (4) Addison's Disease (5) Cushing's Syndrome (6) Low Testosterone (7) Obesity (স্থূলতা)। কিছু কিছু প্লাস্টিক আবার ত্বকের উপরেও কুপ্রভাব ফেলে (Dermatitis)।
সমস্যার সমাধান - প্লাস্টিক দূষণ কমানাের জন্য বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারযােগ্য জিনিসে পরিণত করা হচ্ছে। প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ ব্যবহারে অনীহা উৎপাদনের জন্য কোনাে কোনাে সুপারমার্কেট ক্রেতাদের কাছ থেকে প্লাস্টিক ব্যাগের দাম নিচ্ছে। এছাড়া Bio degradable পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছে। যা প্লাসটিকের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে Bio-degradable পদার্থের একটি অসুবিধা হল এই যে, এটি বিয়ােজনের সময় মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে যা একটি গ্রীণ হাউস গ্যাস। আর একটি উপায় হলো বর্জ্য প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা। হাসপাতালের বর্জ্যকে সাধারণত পুড়িয়েই ফেলা হয়। তবে উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন না করলে প্রচুর বিষাক্ত গ্যাস বায়ুতে মিশে বায়ুকে দুষিত করে তুলতে পারে।
সরকারের করণীয় - প্লাসটিকের বিকল্প পরিবেশ বান্ধব বস্তুর ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরােপ করতে হবে; এ জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। প্লাস্টিক শিল্পের উপর নির্ভরশীল যারা তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ইতোমধ্যে কানাডা, আমেরিকা ও ইউরােপীয় ইউনিয়ন প্লাসটিকে BPA'র ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। দুঃখের বিষয় আমরা এখনাে এ বিষয়ে কোনাে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারিনি।
১। এই প্রবন্ধ পড়ার পর থেকে যথাসম্ভব প্লাস্টিক ও পলিথিন প্যাকেট ব্যবহার বন্ধ করব।
২। দোকানে ও বাজারে পলিথিন প্যাকেটে জিনিস নেব না।
৩। প্লাস্টিক প্যাকেটজাত খাবার বর্জন করব।
৪। কোনাে উৎসব-অনুষ্ঠানে বেলুন ওড়াব না।
৫। প্লাস্টিকের ছুরি, চামচ, চায়ের কাপ, থালা-বাটি-গেলাস ব্যবহার করব না।
৬। প্লাস্টিকের জলের বােতল কিনবাে না।
৭। কখনো প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলবাে না।
৮। রাস্তাঘাটে প্লাসটিক বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখলে তা তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবাে। (এ জন্য অবশ্য সরকারীভাবে বিভিন্ন স্থানে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে) ।
৯। ময়লা ফেলা গাড়ি এলে তবেই ঘরের আবর্জনা সেই গাড়িতে ফেলবাে (যেখানে ব্যবস্থা আছে)।
১০। দোকানে প্লাস্টিকের কাপের বদলে মাটির ভাড়ে চা পান করব। এতে মৃৎ-শিল্পের উপর নির্ভরশীল কুমাের সম্প্রদায় উপকৃত হবে।
১১। অনুষ্ঠান বাড়িতে প্রীতিভােজে থার্মোকল ও প্লাস্টিকের থালার বদলে শালপাতা / কাগজের থালা ব্যবহার করব।
১২। কোনাে উপহার সামগ্রী প্লাসটিকে মুড়ে সুদৃশ্য করার অভ্যাস ত্যাগ করব।
১৩। প্লাস্টিকের / পলিথিনের কু-ফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রয়াসী হব।
১৪। প্লাস্টিক / পলিথিন-এর উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করার জন্য সমবেতভাবে সরকারের কাছে আবেদন করব।
উপসংহার - বর্তমান সময়ে প্লাসটিকের ব্যবহার যেভাবে সর্বব্যাপী বিস্তারলাভ করেছে যে, এই যুগকে প্লাসটিক যুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্লাস্টিক-দূষণ এখন সারা বিশ্বের কাছে অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা আমরাই কমিয়ে আনতে পারি এর ব্যবহার কমিয়ে। এজন্য সবার আগে প্রয়ােজন প্লাস্টিকের কুফল সম্পর্কে প্রচার ও জনচেতনা জাগ্রত করা। জনগণ সচেতন হলে তবেই আমরা সবাই একসঙ্গে এই সমস্যার সমাধানে লড়াই করতে পারবাে। আর যদি আমরা সচেতন না হই, তবে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
তথ্যসূত্র - ইন্টারনেট।
Your email address will not be published. Required fields are marked *