আমাদের বঙ্গোপসাগরে বুকেই লুকিয়ে আছে এমনি একটি দ্বীপ; আমাদের ভারতবর্ষের অধীনে হওয়া সত্ত্বেও যার সম্বন্ধে আমরা অনেকেই জানি না। জানি না সেই দ্বীপের বাসিন্দাদের কথা। তারা দেখতে কেমন, কি ধরনের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। এই পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ সম্পর্কে তাদের আদৌ কোনা ধারণা আছে বলেও মনে হয় না। এই পৃথিবীর অধিবাসী হয়েও তারা এই দীর্ঘ সময় ধরে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকের ছোট্ট এক রহস্যে ঘেরা নির্জন দ্বীপে।
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা নিষিদ্ধ দ্বীপ ‘নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড’। অনেকে এই দ্বীপটিতে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। কথিত আছে ঐ দ্বীপে নরমাংসভোজীরা বসবাস করে। তাই কোনো বহিরাগতরা সেখানে গেলেই তাদেরকে মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হতে হয়। এই দ্বীপে হেলিকপ্টার নামলে, নৌকা, জাহাজ ভিড়লে তারা দৌড়ে গিয়ে তীর-ধনুক দিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মার্কো পোলোর একটি লেখা থেকে জানা যায়, আদিম এই উপজাতির সঙ্গে সভ্য মানুষের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৮৮০ সালে। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল ওই দ্বীপে গিয়ে উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। উপজাতিদের এক প্রৌঢ় দম্পতি এবং চার শিশুকে তুলে নিয়ে আসেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। তাদের নতুন পোশাক ও খাবার দেওয়া হয়। কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক দুজনকে দ্বীপ থেকে আনার পরপরই মারা যায়। বাকি বাসিন্দাদের কিছুদিন রাখার পর কোনা তথ্য না পেয়ে তাদেরকে আবার ওই দ্বীপে রেখে আসা হয়। এই ঘটনার পর আধুনিক সমাজের প্রতি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সেন্টিনেলরা। এরপর থেকে সভ্য মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিজদের আক্রোশ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোক নাথ পণ্ডিতই প্রথমবারের মতো ১৯৯১ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বীপটিতে নিজে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
এই দ্বীপের বাসিন্দারা আদিম মানবের সরাসরি বংশধর। এঁরা এসেছেন আফ্রিকা থেকে। জাতিতে এরা সেন্টিনেলিজ। সেন্টিনেলিরা বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত আদিবাসী আন্দামানি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৫০ কিমি দূরে এই দ্বীপ অবস্থিত। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, দ্বীপটির বয়স প্রায় ৬০ হাজার বছর। আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার। ঐ দ্বীপটির লোকসংখ্যা ৫০ থেকে ৪০০ জনের মতো হতে পারে। এদের প্রধান খাবার মাছ ও নারকেল।
আন্দামান আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম ওঙ্গিরা, উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিল; দ্বীপের জন্য তাদের ঐতিহ্যবাহী নাম চিয়া দাকওকভেয়েহ। বাহ্যিক কিছু দিক থেকে যা কিছু দেখা গেছে, তাতে মনে হয়েছে সেন্টিনালীদের সঙ্গে তাদের দৃঢ় সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। তবে, উনিশ শতকে ব্রিটিশরা উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে যে ওঙ্গিদের নিয়ে এসেছিল, তারা সেন্টিনালী ভাষা বুঝতে পারেনি, সুতরাং মনে হয় এই দুই উপজাতির বিচ্ছেদ অনেকদিন আগেই হয়েছে। ২০১৮ সালে একজন আমেরিকান ধর্মপ্রচারক, জন অ্যালেন চাউ, সেখানে গিয়ে পৌঁছনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারিয়েছেন। তীর নিয়ে তাঁর উপর চড়াও হয় কয়েকজন। এখনও তাঁর দেহ উদ্ধার হয়নি।
ভারতীয় জলসীমায় হওয়ায় এবং ভৌগোলিক সীমারেখার মানদণ্ডে এবং কাগজে কলমে এই দ্বীপটি ভারতের। কিন্তু ভারত সরকার শত চেষ্টা করেও দ্বীপে তাদের নাক গলানোর সুযোগ করতে পারেনি। শেষমেশ ভারত বাধ্য হয়েই আইন করে দিয়েছে, ‘লেট দেম লিভ অ্যালোন’। ১৯৫৬ সালের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী উপজাতি সুরক্ষা আইনের বলে এই দ্বীপে ভ্রমণ এবং পাঁচ নটিক্যাল মাইলের (৯.২৬ কিমি) থেকে কাছাকাছি যে-কোন যোগাযোগের চেষ্টা নিষিদ্ধ, যাতে আবাসিক উপজাতির লোকেদের এমন কোন রোগের সংক্রমণ হতে না পারে যেগুলিতে তাদের কোনরকম প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। ভারতীয় নৌবাহিনীর সেনা, সমুদ্র পথে, এই জায়গায় টহল দেয়। তাই কেউ এখন আর তাদের নির্জনতা, গোপনীয়তা, রহস্যময়তা, স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা ভঙ্গ করার কোনা অধিকার রাখে না। গত ৬০ হাজার বছর ধরে বিশ্বের অন্য কোনও অংশের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে নিজেদের মতো করে বেঁচে আছে তারা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *