ধাঁধা লোকসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ধাঁধার মধ্যে জনসাধারণের অভিজ্ঞতাকে সুন্দরভাবে রূপ দিয়েছে, ধাঁধা হল পল্লীর অতি সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার উপায়। গ্রাম বাংলার জনসাধারণের মনে জীবন ও জগত কে জানার কৌতূহল সৃষ্টি করে। যে বাক্যে একটিমাত্র ভাবকে রূপকের সাহায্যে জিজ্ঞাসার আকারে প্রকাশ করা হয়, তাকে বাধা বলে ধাঁধা। ধাঁধা শুধু ধন্দ লাগায় না ছন্দেরও সৃষ্টি করে। সংক্ষিপ্ত ও ররসোজ্জল চিত্র ফুটিয়ে তোলাই ধাধার লক্ষ্য। কথক ও শ্রোতা তথা উত্তরদাতা নিয়ে ধাঁধার পরিকাঠামো তৈরি হয়। প্রশ্ন ও উত্তর এর ঢং-ই ধাঁধা গঠন বৈশিষ্ট্য।
ধাঁধা লৌকিক-ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই বিচরণ করে থাকে। ধাঁধার মাধ্যমকে মন ভরানো কৌতুক ও প্রান ভরানো আনন্দের সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা যায় না। সমাজে ধাঁধার শিক্ষাগত মূল্য(pedagogical function) অধিক। ধাঁধাকে জ্ঞানের ভান্ডারী ও শিক্ষার কারবারি বলা যেতে পারে। ঠিক এই কারণেই ধাঁধা প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত লোক জীবনে চলে আসছে। সভা-সমিতি, পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপ, আড্ডা, বৈঠকখানা, শিক্ষার উপকরণ, উপাদান ও মাধ্যম। আদিম সমাজে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা সব মানুষ গ্রহণ করতে পারত না। নিরক্ষর মানুষ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে জ্ঞানের, বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। যেমন অনেকে কথকথা, রামায়ণের কাহিনী শুনে,ঐতিহাসিক যাত্রা নাটক দেখে জ্ঞান সঞ্চয় করে। এগুলি চর্চা হয় ধাঁধার মাধ্যমে আবার প্রাত্যহিক জীবনে যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করি সেগুলো দিয়েও ধাঁধা তৈরি করে জ্ঞান-বুদ্ধির চর্চা চলে। তাহলে দেখা যাচ্ছে নিরক্ষর লোক জীবনেও ধাঁধার চর্চা হয় শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে।
আবার শিক্ষিত লোকজীবনেও দেখা যায় চর্চার অভাবে শিক্ষাটি কাজে আসে না ধাঁধা সেই চর্চাটি এনে দেয় লোক শিক্ষার নানাদিক নিয়ে ধাঁধা রচিত হয়েছে শিক্ষার উপাদান হিসেবে বিভিন্ন দিকের ধাঁধার পরিচয় এখানে রাখা যেতে পারে-
1.শিক্ষাচেতনা বা পঠন-পাঠন বিষয়ক ধাঁধা:-
গাছ নয়, তার শুধু পাতা
শুধু সুখ নাই তার, বলে শুধু কথা
বুদ্ধি নাই আপন ধড়ে
বুদ্ধি বিলায়, সকলের তরে - বই (চৌপদী)
2.শব্দার্থ জ্ঞান বিষয়ক ধাঁধা:-
দুই অক্ষরের কোন দ্রব্য রমণীর ভূষণ,
"আ" যোগ করিলে হয় সকলের জীবন,
মহতের প্রিয় হয় "বি" যোগ করিলে,
"প্র" যোগ করিলে ঘটে দুষ্টুর কপালে - হার (চৌপদী)
3.গণিতের জ্ঞান বিষয়ক ধাঁধা:-
ক) কাস্তে-হাতুড়ি বাইশ খান
চোরে নিল তিনখান
হাতে রইল কয়খান - শূন্য (ত্রিপদী)
এই ধাঁধাটি জাড়া (ঘাটাল মহকুমা) মিল্লা গ্রামের ছুতোর পাড়া থেকে গৃহীত। কাঠমিস্ত্রিদের তিনটি যন্ত্র চুরি হয়ে গেলে হাতে কিছুই থাকেনা।
খ) যোগফল যত গুণফল ভাগফল এক
বিয়োগফল শূন্য সংখ্যা দুটি কি কি
হিসেব কষে দেখ দিকি - 2,2 (ত্রিপদী)
গ) একটা হাঁসের বারোটা ডিম
চারটে গরম চারটে নরম
চারটে কালাহিম - গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত (ত্রিপদী)
ঘ) সিকায় ছাগল টাকায় গাই
5 টাকা তে মহিষ পাই
কুড়ি টাকায় কুড়িটি জীব
বলে গেছে সদাশিব
উত্তর: 16 টি ছাগল, একটি গাই ও তিনটি মহিষ
= 16+1+3 = 20টি
শুভঙ্করী অঙ্কের সংখ্যাগণনা পদ্ধতিতে ধাঁধাটির মাধ্যমে লোকজীবনের গাণিতিক বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ধাঁধাটি বলার শেষে ভনিত যুক্ত হয়েছে।
ঙ)'ছ'পন ডোবে 'ন' ইঁদুর
খায় পুয়া পুয়া ধান
আশি বছর রইলে ইঁদুর ক পুয়া খায় ধান?[উত্তর:২,৬৬,১১২ টন]
মোট ইঁদুরের সংখ্যা=(৬×৮০×৯×৮০)=৩,৪৫,৬০০ টি।
৮০ বছর=(৮০×৩৬৫) দিন+লিপ ইয়ারের দিন অর্থাৎ আশি বছর ধরে ইঁদুরগুলো ধান খায়=(৮০×¼কেজি×৩৬৫×৩,৪৫,৬০০)=২৫২২৮৮০০০০ কেজি,=২,৫২,২৮৮ টন।
এখানে লিপ ইয়ারের বছরগুলি যোগ করলে ইঁদুর গুলি আরো (২০×২০×৩,৪৫,৬০০) কেজি=১৩৮২৪০০০০ কেজি=১৩,৮২৪ টন অর্থাৎ মোট(২,৫২,২৮৮+১৩,৮২৪) টন=২,৬৬,১১২ টন ধান খাবে।
4. ভৌগোলিক জ্ঞান বিষয়ক ধাঁধা:-
ক) তিন বর্ণে নামটি তার ছাত্র-ছাত্রী পড়ে,
পেট কেটে দিলে বানান ভুল করে,
মাথা বাদে শেষ অংশ গোলাকার হয়,
বল দেখি নাম তার সেটি গোলাপ কিন্তু নয়,-ভূগোল
খ) দেশ আছে মাটি নাই,
নদী আছে জল নাই,
বন আছে জীব নাই,
পথ আছে জন নাই-মানচিত্র
5. বিজ্ঞান বিষয়ক ধাঁধা:-
ক) মা বেড়ে,বাপ বেড়ে
ছেলে বেড়ায় লেজ নেড়ে,-ব্যাঙাচি।
খ) আচির পাচির চাচির স্মর
ষোলোটি কন্যার একটি বর,- মৌচাক।
গ) পাঁচ বর্ণে নাম তার সবে নক্ষত্র কয়
প্রথমাংশে রং, দ্বিতীয়াংশে পুংলিঙ্গ হয়,- কালপুরুষ।
ঘ) তিন বর্ণের এমন একটি নাম ভেবে বল
যে নাম কঠিন রোগ, ঋতুর বাড়া হলো,- বসন্ত।
6. সবজি বিষয়ক ধাঁধা:-
ক) এত টুকুন গাছে
রাঙা বিটি নাচে,- পাকা লঙ্কা।
খ) সিপাই বুড়ার পোদে চুল,- পেঁয়াজ, রসুন।
গ) পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ চার কোণে চারমাচা পন্ডিত জন বলতে পারো কোন ফলটি চিরকাল কাঁচা?-আলু।
ঘ) দশ শির বটে কিন্তু নয় সে রাবণ,
হস্তীর হস্তে সে হারায় জীবন,- ঝিঙে।
7. ফল বিষয়ক ধাঁধা:-
ক) বন থেকে বেরুলো বাঘ
বাঘের গায়ে চাকা চাকা দাগ,- আনারস।
খ) বন থেকে বেরালো ভুতি
ভুতি বলে তোর পাতে মুতি,- পাতিলেবু।
গ) বক্র ডুব কাজলের ফোঁটা
এত সুন্দরী বনে কেন বাসা,- কাঁঠাল।
8. সামাজিক ধাঁধা:-
ক) ডুবে ডুবে যায়
পঁদে আধার খায়'- সূচ,
(ধাঁধা কথকরা সাবলীলভাবে অশ্লীল শব্দ 'পঁদ' কথাটি প্রয়োগ করেছেন)।
খ) শুতে গেলে দিতে হয়
তা না হলে বিপদ হয়,- খিল।
গ) এই ঘর যাই, ও ঘর যাই,
ধুম করে পড়ে যাই,-লাতা।
ঘ) তপ করে তপস্বীর বেটা
মাথা থাকতে পোদে জটা, -পানা
ঙ) বারো মাসের মেয়ে বটে তেরো মাস কালে,
গন্ডা গন্ডা প্রসব করে অগনন ছেলে,-কলাগাছ।
চ) ত্রিকুট পর্বতে চক্রের নন্দন
তার ভিতরে বিরাজ করে লক্ষীনারায়ন,- ভাত রান্না
ছ) মামা-ভাগ্নি ভাইপো পথে
তিন জনা যায় একসাথে
এ বলে এসো বাপ
ও বলে এসো বাপ
বল দেখি গিরিধারী
সেই লোকটি কে বা? - বাবা তারকনাথ, শিবের অপর নাম তারকনাথ,তারকনাথ কে সবাই বাবা বলে ডাকে।
উপসংহার:
আধুনিক কবি ও লেখক গণ তাদের সাহিত্য সাধনার ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। মেদিনীপুরের এই লোকসম্পদগুলি বর্তমানকালে হারিয়ে যেতে বসেছে, এগুলি দ্রুত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রয়োজন। আনন্দের বিষয় এ ব্যাপারে বহু লোক, সংস্কৃতি বিদ, পন্ডিত ও অনুরাগী এগিয়ে এসেছেন, তাদের সাধুবাদ জানাই এ লেখার ব্যাপারে। কৃতজ্ঞতা জানাই মাননীয়া অধ্যাপিকা সোনালী ব্যানার্জি কে, যিনি স্বল্প পরিসরে লোকসংস্কৃতি বিশাল একটা অংশকে কিভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পাঠদান করা তার পরামর্শ দেওয়ার জন্য।
ঋণ শিকার:-
১। লোক সংস্কৃতির পাঠ ভবন -কেশব আড়ু
২। বাংলার লোক সংস্কৃতি- ড: আদিত্য মুখোপাধ্যায়
৩। সৃজন-শারদ-সংকলন-১৪২৬ - অধ্যাপক লক্ষন কর্মকার (সম্পাদক)
৪। সৃজন-মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি
(বিশেষ সংখ্যা) - অধ্যাপক লক্ষন কর্মকার। (সম্পাদক)
Your email address will not be published. Required fields are marked *