দক্ষিণে উজবেকিস্তান থেকে উত্তরে কাজাখস্তান পর্যন্ত ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ আরাল সাগর ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম লবণাক্ত জলের হ্রদ। আরাল সাগরের বয়স প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বছর। ৫০ বছরে সেই আরাল সাগরের মাত্র ১০ ভাগ এখন টিকে আছে। যার তীরে ছিল সবুজে শোভিত উজবেকিস্তানের উত্তরে মোইনাক শহর। ১৯৬০ সালের আগে জায়গাটা ছিল জমজমাট মৎস্য শিকার বন্দর। ১৯৭৫ সালের দিকে এ বন্দরের জল সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। বর্তমানে তা ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে চলে গেছে। যেটা বর্তমানে মরুর শহরে পরিণত হয়েছে। জল কমতে শুরু করার পর থেকে এ শহরের তাপমাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বাতাসে জলীয়বাষ্প নেই বললেই চলে। সাইবেরিয়ান বায়ুও এখন তার দিক পরিবর্তন করেছে। গ্রীষ্মকালে মোইনাকের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির বেশি এবং শীতে সর্বনিম্ন ৪০ ডিগ্রি হয়।
সাগরটি শুকিয়ে যাওয়ার পেছনের মূল খলনায়ক তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৮ সালে গড়ে তোলা সোভিয়েত তুলা শিল্প তখন সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলো। সোভিয়েত সরকার তাই বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নেয়। সির দরিয়া এবং আমু দরিয়া, এই দুই নদীর জলকে তুলা ক্ষেতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হবে। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে নদীর জল টেনে এনে তুলা চাষ অঞ্চলে সেচ করা হয়। ফলে আরাল হ্রদের দিকে ধাবিত হওয়া জলের পরিমাণ কমে যায়। হ্রদের সাথে কোনো সাগরের সংযোগ না থাকায় আস্তে আস্তে জলের পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু সোভিয়েত সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। জলের পরিমাণ কমে যেতে থাকায় হ্রদের জলেতে লবণের ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়। ফলে জলজ প্রাণীদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এখান থেকে আরাল সাগরের ধ্বংসের সূচনা ঘটে। লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আবহাওয়ায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। ঝড়-তুফানের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণাগারের রাসায়নিক বর্জ্য, বিষাক্ত কীটনাশক, শিল্প-কারখানার বর্জ্য আরাল সাগরের জলেতে নিষ্কাশন করা হতো।
১৯৬০ সালের বিশাল হ্রদের জল দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীরা বিষয়টি লক্ষ্য করে। প্রথম দিকে মোইনাকের অধিবাসীরা আশায় বুক বাঁধে- একদিন জল ফিরে আসবে। কিন্তু জল আর আসে না। অবস্থাসম্পন্ন মৎস্যজীবীরা বিপাকে পড়েন। সবাই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। অনেকেই তুলা কারখানায় চাকরি নেন। অনেকে শহরে টিকতে না পেরে জীবিকার তাগিদে শহর ছাড়তে বাধ্য হন। বিশেষ করে যুবকরা। বেশিরভাগ বাড়িতেই বয়স্করা তাদের নাতি-নাতনি নিয়ে থাকেন। বাচ্চাদের মা-বাবা অন্য শহরে কাজ করে। তাই মোইনাকজুড়ে বাচ্চাদের আধিপত্য। বাচ্চারা পর্যটকদের আশপাশে খেলা করে। তাদের খেলার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো তাদের পূর্বপুরুষদের জীবিকার প্রধান যন্ত্র; মৎস্য ধরার জাহাজ। বহু জাহাজের কঙ্কাল আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে দেখলে যে কেউ ভাববে, সে হলিউডের কোনো ছবির সেটে এসে পড়েছে। বাচ্চাদের অবশ্য এসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। মা-বাবা কাছে না থাকায়, তাদের স্বাধীনতার শেষ নেই। তারা দিনমান তাই উপভোগ করে।
এই ভুতুড়ে শহরে আরও ভর করেছে বিভিন্ন রকম রোগ-শোক। তুলা উৎপাদনে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক ও সার এ শুস্ক উপকূলীয় অঞ্চলকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। যার ফলে বিভিন্ন দীর্ঘ স্থায়ী অসুস্থতা, যেমন- ক্যান্সার, বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি, শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন সংক্রমণ রোগ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। মোইনাকে খাদ্যনালির ক্যান্সারের হার বিশ্বের গড় তুলনায় ২৫ গুণ বেশি।
মোইনাক বন্দর এখন শুধুই স্মৃতি। ওয়্যার ওয়াটার ফাউন্ডেশনের তথ্যচিত্রে মোইনাকের একজন প্রবীণ বলেন, 'আমি মাঝে মাঝেই জাহাজ দেখতে আসি। ছেলে আর নাতি-নাতনিদের সেসব সোনালি দিনের গল্প বলি। তারা এ গল্পকে রৃপকথাই ভাবে। অনেকে আমাকে পাগলও ভাবে। আমার বিশ্বাস, জল একদিন ফিরে আসবে। আর মোইনাকও আবার উচ্ছল হয়ে উঠবে। এটা আমার স্বপ্ন না, বিশ্বাস!'
আরাল সাগর বিপর্যয়কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে করা জরিপ অনুযায়ী আরাল সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ জল শুকিয়ে গেছে। অর্থাৎ এক সময়ের বিশাল আরাল সাগর সামান্য জলাশয়ে পরিণত হয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *