১৯৪৬ সালে বৃহত্তর কলকাতা হত্যাকান্ডের সময় মুসলিম লীগের আক্রমণ থেকে হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য সশস্ত্র ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গড়ে তোলার জন্য পরিচিত ছিলেন যিনি, তিনি গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৯১৩-২০০৫), ওরফে গোপাল পাঁঠা।
"পাঁঠা"- নামটির নেপথ্যে যে গল্পটা কাজ করে, সেটি এইরকম-কলেজ স্ট্রিটে মেডিকাল কলেজের উল্টোদিকে তাদের একটি বুচার শপ বা পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল- যেটি ছিল তাদের পারিবারিক ব্যাবসা। ওনার পরিচয়টা এইরকম- প্রখ্যাত বিপ্লবী অনুকুল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভাইপো। এখনো আছে সেই দোকান। অনুকূল মুখার্জীর পাঁঠা কাটার দোকান। কলকাতার বউবাজারের, মোটামুটি ব্যাবসায়িক স্বচ্ছল পরিবারেই জন্ম। যাই হোক, তিনি অধিক পরিচিত "গোপাল পাঁঠা" নামেই। নামটি পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজে শিরোনামে আসতে শুরু করে ১৯৪৬ এর ১৬ই অগস্টের পর থেকে।
১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলা। দায়িত্ব পেয়েছিল মুসলিম লিগ। মুখ্যমন্ত্রীর নাম ছিল সুরাবর্দী। ১৯৪৬ এর ১৬ অগস্ট,ঠিক এই দিনেই শুরু হয়েছিল কলকাতায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে Direct Action Day, যা The Great Kolkata Killing নামেও পরিচিত। সুরাবর্দী জিন্নার সঙ্গে এক কঠিন ষড়যন্ত্র আঁটলেন। তাই ১৬ আগস্ট ভোরবেলা মুসলমানেরা ধর্মতলা চৌরঙ্গীতে একত্রিত হলেন। মুসলিম লীগের বিশাল সংখ্যক সদস্যের সশস্ত্র সমাবেশ। ওই সমাবেশেই ডাক দেওয়া হয়- এই ভারতে কাফেরদের সঙ্গে থাকলে ইসলাম বিপন্ন হতে পারে, ডাক দেওয়া হয় পৃথক ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ার। মহম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি সামনে রেখে শুরু হয় সশস্ত্র মিছিল, শুরু হয় কাফেরদের ঘড় বাড়ি জ্বালানো, সম্পত্তি লুঠ, খুন ও ধর্ষণ। বউবাজার এলাকায় হিন্দু মহিলাদের ওপর নামানো হয় বর্বরোচিত আক্রমণ, হিন্দু পুরুষ ও নারীদের বিবস্ত্র মৃত দেহ ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছের ডালে। রাজাবাজারে স্কুলের সামনে চারটি মেয়েকে রেপ করে মেরে উলঙ্গ করে লটকে দেয়া হয়েছিল। রেহাই পায় নি শিশুরাও। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায়। শুরু হল হিন্দু কাটা। আর জ্বলতে থাকল হিন্দুদের সম্পত্তি।
কোলকাতার মেয়র ওসমান খান এবং তার সহযোগী সেরিফ খান, সক্রিয়ভাবে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর এই হিন্দু হত্যাকে পরিচালনা করে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর তখন ছিলো মূখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর হাতে। আক্রমণের সময়ে পুলিশ-প্রশাসনের কোনো সাহায্য যাতে হিন্দুরা না পায়, সেজন্য রাজ্যের ২৪টি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের সব কয়টি থেকে হিন্দু পুলিশ অফিসার সরিয়ে ২২টিতে মুসলিম পুলিশ অফিসার এবং ২টিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ অফিসার নিয়োগ করে সুরাবর্দী। শুধু তাই নয়, ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই সুরাবর্দী এবং মেয়র ওসমান খান বসেছিলো লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে এবং সেখান থেকেই তারা নজর রাখছিলো মুসলমানরা কোন এলাকায় কত হিন্দু মারতে পারলো। এমনকি একটি থানা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ থানায় লালবাজার থেকে কোনো পুলিশ ফোর্স পাঠায় নি।
গান্ধীর অহিংস নীতির ধারক হয়ে নিজেদের শৌর্যবীর্য হারিয়ে মুসলিম আগ্রাসনের সামনে ধুলিস্মাৎ হয়ে যেতে থাকে কলকাতার হিন্দু যুব সমাজ। হিন্দু নিধন যজ্ঞ তথা গান্ধী নেহেরুর নিরবতা তাকে চুপ থাকতে দেয়না। গোপাল পাঁঠা কিন্তু একেবারেই মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন না। মিছিল ক্রমশ যখন এগিয়ে আসছিল কলেজ স্ট্রিটের দিকে, গোপাল পাঁঠা এগোচ্ছিলেন তার দোকানের দিকেই, হঠাৎ তার কাছে খবর আসে সেই মিছিলের। এর পর তাঁর চোখে পড়ে মিছিল ক্রমশ এগিয়ে আসছে তার অঞ্চলের দিকে, মুসলিম লীগের সদস্যদের হাতে মজুত ছিল তলোওয়াড় ও ভারী অস্ত্র-শস্ত্র। মুখে আল্লাহ হু আকবর ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান। গোপাল বুঝতে পেরেছিলেন, এই হিংসাত্মক আক্রমণকে ঠেকাতে পাল্টা হিংসা ছাড়া উপায় নেই, শুরু হল হিন্দুদের পাল্টা প্রতিরোধ। তিনি ছিলেন নির্ভিক ডাকাবুকো। একাই দশজনার সাথে লড়ার মত পেটানো শরীর ছিল তার। ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সে সামিল ছিল। বসন্ত, সেই সময়ের কলকাতার এক নাম করা কুস্তিগির ও পালোয়ান, সে ছিল গোপাল পাঁঠার ঘনিষ্ঠ। গোপাল ও বসন্ত, এই দুজনেই ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর সদস্যদের পরিস্কার করে বুঝিয়ে দেন, একটা লাশের বিনিময় নেওয়া হবে দশটা পাল্টা লাশ। কলকাতার বেডন স্ট্রিট থেকে শুরু হয় পাল্টা প্রতিরধের মিছিল, যার নেতৃত্বে ছিল গোপাল ও বসন্ত স্বয়ং। পিস্তল,বোমা, ছুড়ি, তলোয়ার, লোহার রড ও সোডার বোতল- এই ছিল বাহিনির অস্ত্র। গোপালের নিজের সংগ্রহেও ছিল ০.৪৫ বোর মার্কিনী পিস্তল। সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে শুরু হয় গোপালের নেতৃত্বে সংগঠন ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের। বাহিনীর নাম দেওয়া হয়, "ভারতীয় জাতীয় বাহিনী", যাদের কাজ ছিল এলাকায় হিন্দু বিধবা-সধবা ও অবিবাহিত হিন্দু মহিলাদের কে আশ্রয় দেওয়া, পুরুষদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ও গৃহহীনদের জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় বানানো ক্যাম্পে খাদ্য ও পানীয় জলের যোগান দেওয়া।
প্রতি আক্রমণের সামনে পড়ে যখন মুসলিম লীগের পীঠ দেওয়ালে ঠেকবার উপক্রম, তখনই তারা সাহায্য চাইলেন জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন মাথা, মহাত্মা গান্ধীর। মুসলিম লীগের ডাকে সাড়া দিয়ে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা আসেন, দিল্লী থেকে কলকাতায়, গোপাল পাঁঠাকে অস্ত্র সমর্পণে রাজী করাতে। আবেদন করেন গান্ধীজী স্বয়ং। সেই আবেদন সম্পূর্ণ খারিজ করা হয়। গান্ধীজী দু’বার ব্যক্তিগতভাবে গোপাল মুখোপাধ্যায়কে আবেদন করলেন অস্ত্ৰ জমা দিতে। গোপালবাবু তাতে কৰ্ণপাত করেননি। তখন গান্ধীজীর সচিব গোপালবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তিনি অস্ত্ৰ জমা দিচ্ছেন না? গোপালবাবু তাঁকে দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন-হিন্দুদের সম্মান রক্ষায় ব্যবহারযোগ্য অস্ত্ৰ তো দূরের কথা, একটা সূঁচ পর্যন্ত তিনি জমা দেবেন না। মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের প্রধান জিজি আজমীরী ও মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য শেখ মুজিবর রহমান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে করজোড়ে অনুরোধ জানালেন এই রক্তপাত বন্ধ করার জন্য। ঠিক এই ভাবেই, আত্ম সমর্পণ করতে বাধ্য হয় মুসলিম লীগ। পিছু হঠতে বাধ্য হয় গান্ধীর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস।
শেষ বয়েসে এসে গোপাল পাঁঠা বেঁচে থাকেন অঞ্চলের একজন সমাজ সেবক হিসেবেই। একটি স্বেচ্ছা সেবী সংগঠন পরিচালনা করতেন, যার নাম- National Relief Center for Disabilities।
মেদিনীপুরে '৪৬-এর হিন্দুঘাতক সুরাবর্দীর বাড়ি। ওখানেই সুরাবর্দীর জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ ভারত বিভাজনকারী হিন্দু গণহত্যাকারী হোসেন সুরাবর্দীর বাড়ি আমরা এখনও যত্ন করে রক্ষণাবেক্ষণ করছি। কিন্তু ১৯৪৬-৪৭-এ হিন্দুর পরিত্ৰাতা গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে আমরা ভুলে গিয়েছি। যে জাতি রক্ষককে ভুলে যায় আর ভক্ষককে পূজা করে সে জাতিকে বাঁচাবে কে? ইতিহাসকে যারা ভোলে, ইতিহাস তাদের ক্ষমা করে না।
এই ১৬ই আগস্ট দিনটিতে হিন্দুর পরিত্রাতা আমাদের বীর পূর্বপুরুষ গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-কে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *