আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গোটা বিশ্বে সমাদৃত। গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত বিদেশিদের সব সময় শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ও সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণতার জন্য সারা বিশ্বের কাছেই কৌতুহলের উদ্রেক করেছে। লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার নাম এখন সারা বিশ্বেই বেশ পরিচিত। ভারত-চিন সীমান্তে বরফশীতল গালওয়ান উপত্যকার (Galwan Valley) উত্তাপ বাড়াচ্ছে লাল ড্রাগন। এই উপত্যকাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। লাল ফৌজের হামলায় গালওয়ান উপত্যকা আজ নতুন করে রক্তবর্ণ হচ্ছে, তেমনটা কিন্তু নয়। লাদাখের অদূরে এই জায়গার গত শতাধিক বছরের ইতিহাস তো রক্তেই লেখা। আমরা অনেকেই জানি না এই উপত্যকার প্রকৃত ইতিহাস।
প্রায় ১২৫ বছর আগে এই উপত্যকার নামকরণ করা হয়েছিল লাদাখেরই গোলাম রসূল গালওয়ান নামক এক কিংবদন্তী পর্বতারোহী ও অভিযাত্রীর নামানুসারে। কিন্তু কে এই গোলাম রসূল গালওয়ান?
কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীর গুহা থেকে বেরিয়ে পূর্ব লাদাখের ধূসর পাহাড় আর তুষারধবল শিখর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ও বিস্তীর্ণ পাথুরে আর আকসাই চিনের মধ্যে দিয়ে কুল কুল রব তুলে বয়ে গিয়ে নদীটি মিশেছে সিন্ধুর উপনদী শিয়ক এর সঙ্গে। তখনও সে ছিল অনাম্নী।
ইতিহাস বলছে, উনবিংশ শতকে কাশ্মীরের একদল বিখ্যাত মুসলিম লুটেরা, নেতা ছিলেন কারা গালওয়ান নামে একজন। যিনি ধনীর সম্পদ লুট করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কাশ্মীরী ভাষায় ‘গালওয়ান’ বলে পরিচিত ছিল তারা। ওই শব্দের অর্থ – ডাকাত। তবে এই ডাকাতদল ছিল পরোপকারী। এজন্য তার খ্যাতি ছিল রবিনহুডের মতো। শোনা যায়, উনিশ শতকে কাশ্মীরের রাজার ঘরে ঢুকে, তাঁর গলায় ছুরি ধরে রাজপ্রাসাদ লুট করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্য রাজার সেনাদের হাতে ধরা পড়ে কারার প্রাণদণ্ড হয়। আত্মরক্ষার্থে সেখান থেকে পালিয়ে লাদাখে আশ্রয় নেয় তার পরিবার। কিন্তু ততদিনে তাদের নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে গালওয়ান বা ডাকাত শব্দটি।
তবে গালওয়ান নদীর আনুষ্ঠানিক নামটা তারও পরে। এই দস্যু পরিবারেরই বংশধর গুলাম রসুল গালওয়ান। গোলাম রসূল গালওয়ানের দাদা ছিলেন কারা গালওয়ান। ১৮৭৮ সাল নাগাদ গোলাম রসূল গালওয়ানের জন্ম হয় লাদাখের রাজধানী লেহ-তে। বিধবা মা তাকে বড় করে তোলেন। ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা তখন ঘন ঘন তিব্বত, কারাকোরাম, পামির মালভূমি বা মধ্য এশিয়ার দিকে অভিযান পরিচালনা করত। মাত্র ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই সে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের সাথে নানা অভিযানে শামিল হতে শুরু করে। সারাদিন অভিযাত্রীদের সাথে পাহাড়-পর্বত ও বনজঙ্গলে ঘোরাঘুরি করত কিশোর গোলাম রসূল। অভিযাত্রাদেরকে পথপ্রদর্শন করত, যাত্রাপথের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোও তাকেই করতে হত। বিনিময়ে যা পেত তা দিয়েই কোনো রকম খেয়ে-পরে দিন চলে যাচ্ছিল।
কিন্তু ১৮৯২ সালে তার জীবনের আসে এক আমূল পরিবর্তন। চার্লস মারের (সেভেন্থ আর্ল অব ডানমোর) সঙ্গে পামীর ও কাশগার পর্বত অভিমুখে এক অভিযানের একপর্যায়ে ঐ দলটি লাদাখের এক দুর্গম অঞ্চলে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী আর খাড়া গিরিখাতের মাঝখানে আটকে যায়। সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না, কোনো রাস্তাও দেখা যাচ্ছিল না।
যখন সব চেষ্টা করেও অভিযাত্রিক দলটি ব্যর্থ হলো, তখন মাত্র ১৪ বছর বয়সী গোলাম রসূল নিজেই বেরিয়ে পড়ে সেই জটিল গোলকধাঁধার মধ্য থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে। আশ্চর্যজনকভাবে খাদের ভেতর দিয়ে সে বেশ সহজ এক রাস্তা খুঁজে বের করে, যার কারণে এই অভিযান কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই শেষ হয়। বেঁচে যায় অনেকগুলো প্রাণ।
যদিও সেসময় এইসব দুর্গম অঞ্চলে অভিযানকারী হিসেবে কোনও ভারতীয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো না। নামকরণ তো নয়ই। কিন্তু রসুলের সাহস আর দুর্গম পার্বত্য অভিযানে তাঁর অনায়াস দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন ব্রিটিশ অভিযাত্রীরা। দলের নেতা চার্লস মারে কিশোর গোলাম রসূলের প্রতিভা দেখে অবাক হন। তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে, কল কল রব তুলে বয়ে চলা যে নদীটির পাশ ঘেঁষে নতুন রাস্তাটির সন্ধান মেলে, তার নামকরণই করে ফেলেন গোলাম রসূল গালওয়ানের নামে, যা বর্তমানে গালওয়ান নদী নামে পরিচিত। সেই থেকে গোলাম রসূল হয়ে ওঠেন লাদাখের ইতিহাস। তাই তাঁকে সম্মান জানাতে এই নদী থেকে এই উপত্যকার নাম হয় ‘গালওয়ান’ ভ্যালি। ঐতিহাসিক গবেষকদের মতে, সেসময় কোনও ‘নেটিভের’ এই সম্মানপ্রাপ্তি বিরল ঘটনা।
মাত্র ৪৭ বছর বয়সেই গোলাম রসূল পরপারে পাড়ি জমান। জীবনের নানা অভিযানের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি লিখে ফেলেন একটি আত্মজীবনী, 'সার্ভেন্ট অব সাহিবস' বা 'সাহেবদের ভৃত্য'। দারিদ্র্য আর অর্থকষ্টের মধ্যে বেড়ে ওঠা গোলাম রসূল খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না। তবে গোলাম রসূল গালওয়ান লাদাখি, উর্দু, তুর্কি, তিব্বতি এবং কাশ্মীরি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *