বরাবর কংগ্রেসের ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যখনই দল বিপদে পড়েছে, এগিয়ে এসেছেন। লড়াই করে দলকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু গত তিন সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে যে লড়াই করছিলেন, তাতে জিততে পারলেন না প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সোমবার প্রয়াত হলেন তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪।
গত ৯ অগস্ট রাতে নিজের দিল্লির বাড়িতে শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন প্রণববাবু। পর দিন সকাল থেকে তাঁর স্নায়ুঘটিত কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাঁ হাত নাড়াচাড়া করতে সমস্যা হচ্ছিল। চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এমআরআই স্ক্যানে দেখা যায়, তাঁর মাথার ভিতর রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। এক দিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অস্ত্রোপচার, তার উপর করোনা সংক্রমণ— জোড়া ধাক্কা সামলাতে পারলেন না তিনি। জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। অস্ত্রোপচারের আগে, নিজের করোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর টুইট করে জানিয়েছিলেন তিনিই। সেটাই ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের শেষ টুইট। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর অবস্থার উন্নতি হয়নি। ১৩ অগস্ট থেকে তিনি গভীর কোমায় চলে যান। যাবতীয় লড়াই সত্ত্বেও হাসপাতালে ভরতির ২২ দিনের মাথায় গত ৩১ শে আগষ্ট সোমবার, বিকেল ৫ টা ৪৬ মিনিটে দিল্লির আর্মি হসপিটাল রিসার্চ অ্যান্ড রেফারালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন স্বাধীনতা উত্তর সর্বভারতীয় রাজনীতির সফলতম বাঙালি এবং দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন, ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি ১০ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন পরে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হন কামদাকিঙ্কর।
প্রণব মুখোপাধ্যায় শিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি। এর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন পাশ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে কলকাতায় ডাক বিভাগের কারণিক পদে যোগ দেন তিনি। মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনে প্রথম দিকে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত "বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল"র ২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ‘দেশের ডাক’ নামে একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছিলেন তিনি।
১৯৫৭ সালের ১৩ ই জুলাই বাংলাদেশের নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামের শুভ্রা মুখার্জী সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বাবার পথ ধরে শুরুতে রাজনৈতিক দল কংগ্রেসে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও স্থানীয় নেতারা তাকে সে সুযোগ দেননি। পরে কংগ্রেস থেকেই বেরিয়ে আসা অজয় মুখার্জীর বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন। কিন্তু তাঁর মেধা আর জ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে মি. মুখার্জী তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে পাঠান ১৯৬৯ সালে। সেই থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু।
মূলতঃ রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি আলো ছড়াতে শুরু করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পার্লামেন্টে তাঁর তৎপরতার মাধ্যমেই। "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই বড় কারণ প্রণব বাবুর জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশে। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মেধায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে কংগ্রেসে নেন ও বড় বড় নেতাদের রেখে তাকেই নাম্বার টু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক সময় তাকে ইন্দিরা গান্ধীর মানসপুত্র বলা হতো। অতি অল্প বয়সে ১৯৮২ সালে তাকে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী"। ১৯৮৫ সালে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হন প্রণববাবু। ২০০০ সালে তাঁকে ফের এই পদ গ্রহণ করতে হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ইন্দিরাগান্ধীর হত্যার পর রাজীবের সঙ্গে একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হন প্রণব মুখার্জি। এসময় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। এসময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে একটি নিজস্ব দল গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা হলে, এ দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসের যোগদান করেন।
১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হত্যার পর কংগ্রেসে ফের সক্রিয় হন প্রণব। তাঁকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। পরে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। নরসিংহ রায়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান তিনি।
২০০৭ সাল একই ভাবে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে জোর আলোচনা হয়। কিন্তু তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যহতি দিতে রাজি ছিলেন না মনমোহন সিং। ফলে সেযাত্রায় রাষ্ট্রপতি হওয়া হয়নি তাঁর। মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন প্রণববাবু। অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর ঘোষণা করেন প্রণব। এর পর কংগ্রেসের তরফে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই প্রথম বাঙালি হিসাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালে তাঁকে ভারতরত্নে ভূষিত করে কেন্দ্রীয় সরকার। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কখনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সময় দিল্লিতে বাঙালির অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।
প্রথম বাঙালি ভারতের রাষ্ট্রপতি। ভারতরত্ন। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সময় দিল্লিতে বাঙালির অন্যতম প্রতিনিধি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *