কালাচ সাপ! শুনলেই লোকজন ঠোঁট বেঁকিয়ে তাকান। আসলে বিষধর সাপের যে এলিট ক্লাস অত্যন্ত বেশি অ্যাক্টিভ, তার মধ্যে এই সাপের নাম তেমন প্রচলিত নয়। অথচ এদের বিষ শঙ্খচূড়, কেউটে, গোখরো বা অন্য বিষাক্ত সাপের থেকে অত্যন্ত বেশি অ্যাক্টিভ। পশ্চিমবঙ্গে গড়ে প্রায় একহাজার মানুষ এই সাপের কামড়ে প্রতি বছর মারা যান। তবুও, কালাচের ইমেজ আমজনতার কাছে অতটা ভীতিপ্রদ নয়। তার কারণ, এদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এমনই যেটা অন্য বিষধর সাপেদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
আমাদের ভারতবর্ষে শতাধিক প্রজাতির সাপের দেখা মেলে। এসব সাপের বেশিরভাগই বিষহীন। যাদের দংশনে মানুষের মৃত্যু হয় না। তবে কিছু সাপ আছে যাদের দংশনে মৃত্যু হতে পারে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তিন প্রজাতির গোখরা, চার প্রজাতির বোরা, দুই প্রজাতির ক্রেট সাপ আছে, যা বিষধর।
বিষাক্ত সাপগুলোর একটি হচ্ছে গুপ্তঘাতক বিষাক্ত "কালাচ"। কিন্তু এই সাপকে কেন গুপ্তঘাতক বলা হয়?
পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতবর্ষে এই সাপ আছে কিন্তু সচরাচর মানুষের চোখে পড়ে না, কারণ এরা নিশাচর। গভীর রাতে এরা বিচরণ করে। এই সাপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে এরা শতভাগ বিষ প্রয়োগ করে। অন্যান্য বিষাক্ত সাপ দংশন করলে তার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ থাকে ড্রাইবাইট।
ড্রাইবাইট হচ্ছে দংশন করবে ঠিকই কিন্তু বিষ প্রয়োগ করবে না। তবে কালাচের দংশনে কোনো ড্রাইবাইট নেই। সে দংশন করা মানেই বিষ প্রয়োগ হবে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে এই সাপ দংশন করলে মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না কারণ সাপটির দাঁত মশার হুলের মতো। তাই এর দংশনে বেশিরভাগ সময় দাগ পড়ে না। এমনকি জ্বালা-যন্ত্রণাও হয় না, আক্রান্ত জায়গা ফোলেও না। এতে ৯০ শতাংশ রোগী বুঝতেই পারে না তাকে সাপে দংশন করেছে।
এরা খাড়াভাবে উপরে উঠতে পারে। বর্ষাকালে ও গরমকালে এই সাপ খাদ্যের সন্ধানে ঘরের মধ্যে বিছানার ওপর বালিশের নীচেও চলে আসে। কাঁথার ভাজে, মাদুরের ভেতর এরা থাকতে খুব পছন্দ করে। ঘুমন্ত অবস্থায় পাস ফেরার কারণে শরীরের নিচে চাপা পড়ে অথবা হাত-পা নড়াচড়া করলে নীরবে দংশন করে দ্রুত কেটে পড়ে এ সাপ। প্রচলিত আছে এই সাপ ঘুমন্ত মানুষের বিছানায় উঠে আসে ঘামের গন্ধ নিতে। তবে এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতবাদ থাকলেও বৈজ্ঞানিকভাবে সাপের ঘ্রাণ শক্তি আছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘুমন্ত মানুষকে দংশন করে বলে এই সাপকে ‘ঘামচাটা’ সাপও বলা হয়। তাই এই সাপ এবং এই সাপের কামড় এমনই রহস্যময়।
কি এই কালাচ?
1. এর ইংরেজি নাম Common Krait বৈজ্ঞানিক নাম Bungarus caeruleus।
2. এদের দেখতে কুচকুচে কালো বা নীল সে কালো রংয়ের এবং এদের গায়ে গলা থেকে লেজ পর্যন্ত দুটো করে সাদা চুড়ির মত সরু সরু ব্যান্ড থাকে।
3. এদের দেহ সাধারণত খুব সরু হয় এবং এদের চোখ খুব ছোট হয়।
4.এই সাপ ফণাহীন ও অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের।
5.সাধারণত কালাচকে মাটির বাড়ির আনাচে কানাচে, ঝোঁপঝাড়ে দেখতে পাওয়া যায়।
6.কালাচ সাপকে সচরাচর খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। কারণ তারা গভীর রাতে বের হয় এবং সূর্যের আলো ওঠার আগেই লুকিয়ে পড়ে।
7.কালাচের প্রজনন মৌসুম মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
8. এদের বিষ নিউরো টক্সিক,এদের বিষ যেকোনো কোবরার থেকে পাঁচগুন তীব্র এবং কার্যকরী।
9. এরা সাধারণত ব্যাং, টিকটিকি, ফড়িং খেয়ে থাকে।
9. এই নাম ছাড়াও আরও নাম আছে। শিয়রচাঁদা, নিয়রচাঁদা, ডোমনাচিতি, শাঁখাচিতি।
কি করে বুঝবেন কালাচ সাপ কামড়েছে?
1. সাধারণত সকাল বা ভোরের দিকে শুরু হয় পেটে ব্যথা, গলায় ব্যথা কিংবা সারা শরীর জুড়ে অস্বস্তি। যেন জ্বর আসছে। মনে রাখতে হবে কালাচ কিন্তু নিশাচর সাপ, তাই তার কামড়ের প্রতিক্রিয়া ভোরবেলা বা সকালে বেশি দেখা যায়।
2. সময় গড়ালে রোগে শরীরের রোগীর চোখের পাতা পড়ে আসবে কিছুতেই সে চোখ তুলে তাকাতে পারবেনা।
3. মনে রাখতে হবে কালাচের কামড়ে ক্ষত স্থান ফুলে যায় না, কোথাও ব্যথা থাকে না। তাই এই চিহ্ন গুলির দিকে নজর রাখা দরকার। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে কিন্তু রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
কালাচ সাপ থেকে বাঁচতে করণীয়:-
1. অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে।
2. রাতে চলাচল করলে টর্চলাইট ব্যাবহার করতে হবে।
3. সাপটিকে দেখলে মারতে না গিয়ে তাকে নিজের মতো চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
4. বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে।
5 গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বাড়ির আশেপাশে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে রাখতে হবে।
সাপ দেখলে অযথা ভয় পাবেন না, সাপ খুবই নিরীহ সরীসৃপ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সাপ দেখলে লাঠি হাতে তাকে মারতে উদ্যত হবেন না, অবশ্যই বনদপ্তর বা কোন প্রেমিকে এ খবর দিন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *