"চে" ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত।
স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রিয়’; কিউবায় সফল বিপ্লবের পর সেখানকার অধিবাসীগণ তার নাম দিয়ে দেয়-‘চে’। তিনি এই নামটিকে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল, অর্থাৎ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহার করতেন শুধুই এই শব্দটি-‘চে’।
১৯২৮ সালের ১৪ই জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও গ্রামে বিপ্লবের জন্ম নেন এই প্রবাদপুরুষ; পিতা আর্নেস্তো গেভারা লিনচ ও মাতা সিলিয়া দে সেরনা। আইরিশ পিতা ও স্প্যানিশ মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চে’ই ছিলেন সবার বড়। তাদের পরিবারে বইত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা, যা ভবিষ্যত জীবনে বিপ্লবী চে’কে গড়ে তুলতে শেকড়ের ভূমিকা পালন করেছে। চে’র পিতা ছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় রিপাবলিকানদের গোঁড়া সমর্থক, চে’র ছোটবেলাতেই তিনি অনুভব করেন যে তার পুত্রের মধ্যেও আইরিশ বিদ্রোহের রক্ত প্রভাব ফেলছে।
খেলাধুলা যেমন পছন্দ করতেন, তেমনি পারদর্শীও ছিলেন চে…তা সাঁতার, গলফ, ফুটবল, শুটিং, সাইক্লিং, রাগবি যাই হোক না কেন! এককথায় একজন খেলুড়ে ব্যক্তি ছিলেন তিনি। রাগবি খেলায় প্রচন্ড ক্ষিপ্রতা কাজ করতো তার মধ্যে, রাগবি ইউনিয়নের নিয়মিত সদস্যও ছিলেন. বারকয়েক বুয়েন্স এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেনও। সাইক্লিংয়ে কখনোই ক্লান্ত হতেন না চে, যখনই সময় পেতেন ঘন্টার পর ঘন্টা সাইক্লিং করতেন। ১২ বছর বয়সে পিতার কাছে দাবা খেলা শেখার পর থেকে প্রায়ই বুদ্ধি শানিয়ে নিতেন দাবার ছকে, স্থানীয় প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছিলেন। ঘোড়সওয়ারিও শিখেছিলেন শখ করে, কিছুই বোধহয় বাদ দিতে চাননি চে…হয়তো জীবনের কোন স্বাদই!
তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা মোটরসাইকেল ভ্রমণ করেছিলেন। ঐ ভ্রমণটি তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ ছিল, কারণ তখনই তার চোখে ভালো করে ধরা পড়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সার্বিক অসহায়ত্ব। চারপাশে মূর্তমান দারিদ্রের কশাঘাত চে’র তরুণ মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি চোখ মেলে দেখতে পান তার চেনা জগতের সাথে সমান্তরালে বয়ে চলা এক অচেনা জগত, শোষিত মানুষের জগত। এই ভ্রমণ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে চে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। চে অনুভব করেন, পরিবর্তন অনিবার্য; আর এই পরিবর্তনের জন্য আরো বেশি অনিবার্য একটি সশস্ত্র বিপ্লব। তিনি বিশ্বাস করতেন বিপ্লব কেউ কাউকে প্রদান করে না, বিপ্লব ছিনিয়ে আনতে হয়, বিপ্লব ঘটাতে হয়; কেউ কাউকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দেয় না, মুক্ত নিজেদেরকেই হতে হয়।
চে গুয়েতামালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে তার বৈপ্লবিক চেতনার ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও রাউল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে পরিচয় হবার পর তিনি প্রভাবান্বিত হয়ে তাদের আন্দোলনে যোগদান করেন এবং তারা কিউবার মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করেন। দুই বছরব্যাপী তাদের আন্দোলনটি সফল হয় এবং চে কিউবার জনগণের কাছে আপনজন হিসেবে আদৃত হন, বিপ্লবী হিসেবে হন বিশ্বপরিচিত।
কিউবাকে স্বাধীন করার কৃতজ্ঞতায় বন্ধু চে গেভারাকে কিউবার মন্ত্রীত্ব দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। কিন্তু রক্তে যাঁর বিপ্লবের আগুন, তাঁর মন্ত্রীত্বের কুর্সি হেলায় কুর্সি ছুঁড়ে ফেলে নেমে পড়লেন আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। শুরু করলেন বলিভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ। তৈরী করলেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (বলিভিয়া)।
গোটা বিশ্ব গেরিলাযুদ্ধ হিসেবে চিনেছে চে এর হাত ধরে। গেরিলা যুদ্ধকালীন যখন সবাই বিশ্রাম নিত তখন অন্যদের অবাক করে দিয়ে চে তার নোটবই বের করে ডাক্তারদের হস্তাক্ষরের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রায় অস্পষ্ট অক্ষরে লিখে চলতেন ডায়েরী। এই ডায়েরীটি তার বলিভিয়ার ডায়েরী বলে খ্যাত। বলিভিয়ার গেরিলা যুদ্ধকালীন সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভিয়ান সেনার হাতে বন্দী হন চে। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। চে গেভারাকে হত্যার দায়িত্ব নেওয়া বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান ঘরে ঢুকলেন। ঘাতকের দিকে চোখ তুলে তাকালেন চে , নিস্পৃহ দৃষ্টিতে।
আমি জানি তুমি আমাকে মারতে এসেছো, বলে মৃদু হাসলেন। নাও, গুলি করো, তুমি কেবল একজন মানুষকে মারতে পারবে। তার মতাদর্শকে নয়।
মারিও তেরান প্রথমে চে গেভারার হাতে, তারপর পায়ে, তারপর গলায় নবম গুলিটি করলেন। একটুও আওয়াজ না করে, চোখ খুলে গুলি খেতে খেতে, চোখ খুলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন চে গেভারা। মাত্র ৩৯ বছর বয়েসে।
বিপ্লব কখনো বিপ্লবীর মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে যায় না, চে’ও তাই বেঁচে থাকবেন আজকের ও আগামীর বিপ্লবীদের মাঝে…তাই তার ব্যক্তিত্ব যেন অস্পষ্ট না হয়ে যায়…।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Biplob dirghojibi hok
Very good