গান্ধী হত্যার অজানা কারণ...নাথুরাম গডসের স্বীকারোক্তি ।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি দিল্লির 'বিড়লা হাউস'-এ বিকেলের প্রাত্যহিক ধর্মীয় প্রার্থনায় যাওয়ার সময়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে সামনে থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেন নাথুরাম গডসে। নাথুরাম গডসে ব্ল্যাক পয়েন্ট রেঞ্জ থেকে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। যে সাত-বোরের স্বয়ংক্রিয় ব্যারেটা পিস্তল থেকে মি. গডসে পরপর তিনটে গুলি চালিয়েছিলেন, সেটি গোয়ালিয়র থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা ১৭ মিনিটে মৃত্যু হয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর।
আশ্চর্যের বিষয় হলো হত্যা করার পর নাথুরাম গডসে সেখান থেকে পালানোর কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ সে চেয়েছিল তার এই জঘন্যতম হত্যার কথা সারা দেশবাসী যাতে জানতে পারে। দিল্লির লাল কেল্লায় গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলার সময়ে নাথুরাম গডসে গান্ধীজী কে হত্যা করার জন্য তিনি একটা নয় দুটো নয় প্রায় মোট ১৫০ টি কারণ দেখিয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো-
১. ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল জেনারেল ডায়ারের গোটা দেশ শাস্তি চেয়েছিল। কিন্তু গান্ধী সেই দাবি খারিজ করেন।
২. ভারতবাসী চেয়েছিল যে বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং সুখদেবের ফাঁসি আটকানোর জন্য গান্ধী কিছু পদক্ষেপ করুক। কিন্তু এই সব কিছু তিনি করেননি। উল্টে আবার গান্ধী বলেন, এরা পথ ভ্রষ্ট বিপ্লবী, এরা যে পথে হাঁটছিল সেগুলি সন্ত্রাসের পথ, তাদের ফাঁসি তিনি আটকাবেন না।
৩. ১৯৪৬ সালের ৬ ই মে যখন দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে সেই সময় গান্ধী হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেন যে তারা যেন মুসলিম লিগের লোকের বিরুদ্ধে যেন না লড়াই করে। সেই সময় মুসলিম লীগের লোকেরা কেরালায় প্রায় ১৫০০ হিন্দুকে হত্যা করেছিল। এছাড়া আরও ২০০০ হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়।
৪. অনেকবার ভারতের মহান যোদ্ধা শিবাজী মহারাজ, রানা প্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিং কে পথ ভ্রষ্ট ভারতীয় বলেছিলেন গান্ধী।
৫.কাশ্মীরের রাজা হরি সিংকে কাশ্মীর ছেড়ে দিতে বলেন গান্ধী। কারণ কাশ্মীরে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।
৬. ত্রিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু গান্ধী নিজের ক্ষমতা বলে নিজের অনুগত পট্টভি সিতারামাইয়াকে কংগ্রেসের সভাপতি করেন।
৭. ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সর্দার প্যাটেল প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীর নির্দেশে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়।
৮. ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট কংগ্রেস সরকার ঠিক করে যে তারা ভারত বিভাজনের বিরোধীতা করবে। তবে যে সভাতে এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে সেই সভাতে গান্ধী একদম শেষ সময়ে পৌঁছান এবং দেশভাগের বিষয়টিকে তিনি সমর্থন করেন। এর আগে গান্ধী নিজেই বলেছিলেন দেশ ভাগ তার নিজের লাশের উপর দিয়ে হবে।
৯. এরপর নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে ভারত সরকার সোমনাথ মন্দির আবার নির্মাণ করবেন, কিন্তু সেই সময় গান্ধী সরকারে না থাকা সত্ত্বেও সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করান। আবার ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি দিল্লির মসজিদ যাতে সরকারি টাকায় নির্মাণ করা হয় তার জন্য তিনি অনশনে বসেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার দাবি মানতে বাধ্য করান সরকারকে।
১০. ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা করলে গান্ধী আবার ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই অনশনে বসেন। এর ফলস্বরূপ ভারত সরকার পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। গান্ধীর এমন সিদ্ধান্ত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সেই সময় ভারতের মুসলিমদের খুশি করতে হিন্দুদের নানা ভাবে প্রতারিত করেছেন তিনি।
গান্ধী হত্যার বিচার ১৯৪৮ সালের মে মাসে দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লায় শুরু হয়েছিল। প্রধান আসামী ছিলেন গডসে এবং তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্তে। একই সঙ্গে সহ-আসামি হিসাবে আরও ছয় জনের বিচার শুরু হয়েছিল। বিচার প্রক্রিয়া খুব তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ড রোধে ব্যর্থতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এড়ানোর জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেলের ইচ্ছাতেই এই কাজ করা হয়েছিল। দিল্লির লাল কেল্লায় গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলার সময়ে নাথুরাম গডসে নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দেশভাগের জন্য গান্ধীজীকেই দায়ী বলে মনে করতেন।
গডসে আরো বলেন "গান্ধীজী দেশের জন্য যা করেছেন, আমি তাকে সম্মান করি। গুলি চালানোর আগে তাই আমি মাথা নীচু করে তাঁকে প্রণামও করেছিলাম"। গান্ধী হত্যার দায়ে ১৯৪৯ সালের ৮ই নভেম্বর নাথুরাম গডসে আর নারায়ন আপ্তে'র ফাঁসির সাজা শোনালেও নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে সহ পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছিল আদালত। পরে দুজন ছাড়া পেয়ে যান। ১৯৪৯ সালের ১৫ই নভেম্বর নাথুরাম গডসে ও তাঁর এক সহযোগী নারায়ন আপ্তেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
হিন্দু মহাসভার সহ সভাপতি নারায়ণ শর্মা সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে জানিয়েছেন, "১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়ে যে ভাবে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একজন কট্টর হিন্দু হিসাবে মেনে নিতে পারেননি গডসে। সেজন্যই তিনি গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। এই ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মকে জানানোর দরকার"।