কেউটে শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ কালকূট থেকে। কেউটে সাপের আঞ্চলিক নাম পদ্মকেউটে, আলকেউটে, কালকেউটে, বাঁশবুনে কেউটে ইত্যাদি। ইংরেজি নাম Monocellate Cobra, Bengal Cobra। বৈজ্ঞানিক নাম Naja naja Keauthia কেউটিয়া বাংলা কেউটে নাম থেকে নেয়া।
কেউটে সাপ লম্বায় সর্বোচ্চ ২.২৫০ মি. হতে পারে। এটি ফণাযুক্ত বিষধর সাপ। এ সাপের ফণার পেছন দিকে গোলাকার বা রম্বস আকারের বা ইংরেজি ঙ বর্ণের মতো হালকা গোলাপি সাদাটে চিহ্ন দেখা যায়। পেছনে ফণার শেষ দিক একটা বা দুটো সাদা দাগ দেখা যায়। এ সাপের দেহের রং প্রায় ঘন কালো। তবে এলাকা বিশেষে বা বাসস্থানের পরিবর্তনের জন্য এদের গায়ের রং সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।
গোটা ভারত বর্ষ ছাড়াও, পশ্চিম থেকে চীন, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়াতে। মালয় দ্বীপপুঞ্জ, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, লাওস, নেপাল ও থাইল্যান্ড এদের আদি নিবাস। এরা সাধারণত স্যাঁতসেতে ছায়াছন্ন স্থান, বিলাঞ্চল ও জলাভূমি এলাকায় বিচরণ করতে পছন্দ করে। পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত বর্ষাকালে এ সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা পড়ে। কেউটে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বদমেজাজি সাপ। আক্রান্ত না হলেও কামড়াতে তেড়ে আসতে পারে। এরা অন্য সাপের মতোই নিশাচর। এরা পানিতেও কামড়াতে পারে।
জঙ্গল ও হোগলা, নলখাগড়ার জলাভূমি, ধানক্ষেত, বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থাকলেই সেখানে কেউটে সাপ আবাস করে নেবে। অন্যান্য সব সাপের মতো কেউটেও জ্যান্ত প্রাণী খায়। ছোট স্তন্যপায়ী, পাখি, ডিম, সাপ, ব্যাঙ, মুরগির ছানা,ইঁদুর, মাছ, কীট-পতঙ্গও কেউটের খাদ্যতালিকায় রয়েছে। তবে শীতল রক্তের মাছ ও ব্যাঙ কেউটে খুব ক্ষুধার্ত না হলে ধরে না।
ভারতবর্ষে কেউটে বা গোখরোর কামড়ে বেশিরভাগ মানুষ আক্রান্ত হন। এদের বিষ দেখতে জলপাই রঙের এবং তেলের মতো। বিষের চরিত্র নিওরোটক্সিন। নিওরোটক্সিন মানুষের শ্বাস নেয়ার ক্ষমতা লোপ করে দেয়। কামড়ের জায়গায় আগুনের ছ্যাকা লাগার মতো জ্বালা শুরু হয়। লাল হয়ে ফুলে ওঠে, কামড়ের ছিদ্র দিয়ে রক্তরস বেরিয়ে আসে। ক্রমশ পা অবশ, ঘাড় ঝুলে পড়া, ঠোঁট, জিভ, গলার পেশি অবশ হতে থাকে। নিচের ঠোঁট ঝুলে পড়ে লালা ঝরতে শুরু করে। বমি হয় কখনো কখনো দেহের নরম অংশ থেকে রক্ত বের হতে পারে।
কেউটের বিষদাঁতও সামনের দিকে অবস্থিত। আকারে ছোট অনেকটা কুলের কাঁটার মতো ভেতরের দিকে বাঁকানো। দাঁতের সামনের দিক নালিকাটা। এই নালি বিষথলির সঙ্গে যুক্ত। কেউটে ঘাপটি মেরে, কখনো তাড়িয়ে শিকার ধরে। কেউটের মারাত্মক মারণ বিষে প্রায় ১২টি এনজাইম (দেহকোষের জৈব রাসায়নিক পদার্থবিশেষ) রয়েছে। ছোট শিকার কেউটে কামড়ে ধরে রাখে, কম ক্ষেত্রে পেঁচিয়ে ধরে। বিষের তীব্রতা এত বেশি যে ছোট স্তন্যপায়ী তিন-চার মিনিটে অবশ হয়ে যায়। তবে ব্যাঙ মারতে সময় লাগে।
সাপে কামড়ানোর ৮৬ শতাংশ মানুষ ওঝার কাছে যান চিকিৎসার জন্য। মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ যান দক্ষ চিকিৎসকের কাছে। বর্তমান উন্নত চিকিৎসার জগতে সাপে কামড়ানোর মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে শুধুমাত্র দরকার যথাযথ সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। সব জীবনই প্রকৃতির নিয়মাধীন এবং নিজস্ব গতিধারায় বহমান। পরিবেশের সুনিপুণ ভারসাম্য রক্ষা ও জটিল খাদ্য চক্রের সক্রিয় উপাদান হিসেবে অন্য যে কোনো প্রাণীর মতো প্রকৃতিতে সাপেরও একটি তাৎপর্য ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং নির্বিচারে সাপ মারা সমীচীন নয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *