১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সৈয়দপুরকে ঘিরেই হয় গণহত্যা পর্ব ৷ ২৩ মার্চের দিন শহর জুড়ে মাডো়য়ারি ও বাংলাভাষীদের খুনের পর্ব চলে ৷ প্রথমে রেল কারখানার চুল্লিতে শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয় ৷ ২৪ মার্চ পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের রুখতে স্থানীয় জননেতা মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার বাঙালি দেশীয় অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাদেরই কচুকাটা করে পাকা সেনা ও বিহারী মুসলিমরা৷ এ হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা ‘বিহারি জনগোষ্ঠী’৷
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন তারিখে সৈয়দপুর শহরে সংগঠিত একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ হয়। এ দিন শহরের ৪৭৮ জন মাড়োয়ারি পরিবারের সদস্যকে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার নামে ট্রেনে তোলা হয়। এরপর রেলওয়ে কারখানার উত্তর প্রান্তে সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁদের সর্বস্ব লুটে নেওয়া হয়। ৪৭৮ জন হিন্দু মারোয়াড়ি আবালবৃদ্ধবণিতাকে নির্বিচারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী অবাঙ্গালী বিহারী ও বাঙ্গালি রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী সম্মিলিতভাবে হত্যা করে। পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষ ১৩ জুনের এ গণহত্যার নাম দিয়েছিল, ‘অপারেশন খরচাখাতা’। যদিও সরকারিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মরণপণ সংগ্রামের ইতিহাস বা মুক্তিযুদ্ধের তথ্যে এর নাম ‘গোলাহাট গণহত্যা’।
পাকিস্তানী সেনারা সৈয়দপুরের হিন্দু সম্প্রদায়কে ভারতে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই মোতাবেত ১৯৭১ সালের ১৩ জুন সকাল ৫টায় সৈয়দপুরের মারোয়ারিপট্টি ও অন্যান্য এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তানী বাহিনী এবং বিহারীদের সহযোগিতায় তাদেরই তত্ত্বাবধানে আত্মরক্ষার জন্য ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়। পাকিস্তানী সেনারা সৈয়দপুর শহর থেকে সবাইকে ট্রেনে উঠিয়ে চিলাহাটির দিকে যেতে থাকে। ট্রেনের চারটি বগিতে সবাইকে তোলা হয়। প্রথম দুটি বগিতে পুরুষদের তোলা হয় এবং পরের দুই বগিতে নারী ও শিশুদের তোলা হয়। গোলাহাট রেলকারখানার শেষ মাথায় হঠাৎ করে ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেনটি থামার সঙ্গে সঙ্গে একজন যাত্রীকে জানালা দিয়ে বের করে তরবারি দিয়ে মাথাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়।
পুলিশের পোশাকে অবাঙালী বিহারী মুসলমানরা রামদা, চাপাটি নিয়ে ট্রেনে উঠে পরে। এদের মধ্যে কয়েকজন বলতে থাকে, ‘মালাউনদের খতম করব এবার।’ এরপর তারা সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে ধরে রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে। এই চিত্র দেখে তপন কুমার প্রথমে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা তাকে ধরে ফেলে। তখন তপন সৈন্যদের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। তপন কুমার দাস সেই দিনের স্মৃতিচারণে বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনারা ১৩ জুন আনুমানিক সকাল ৫টায় ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ৪টি বগিতে আমাদের তোলে। ট্রেনে ওঠার পর পাকিস্তানি সেনাদের বোঝাতে অসুবিধা হলো না, এই দিন আমাদের শেষ দিন। সে সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ করে ট্রেন এসে ফাঁকা স্থানে দাঁড়ায়। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা যাত্রীদের কিল-ঘুষি-লাথি মেরে ট্রেন থেকে নামাতে থাকে। ট্রেনের যাত্রীদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করতে শুরু করে। যাত্রীদের অনেকে ধারাল অস্ত্রের আঘাত সইতে না পেড়ে গুলি করে মারার জন্য অনুরোধ করে। পাকিস্তানী সেনাদের জবাব ছিল গুলির অনেক দাম। একে একে বগি থেকে নামিয়ে তলোয়ার দিয়ে কাটতে শুরু করে। ট্রেনের একপাশে যখন গণহত্যা চলছিল সে সময় অন্য পাশ থেকে আমিসহ কয়েক যুবক দশ-পনেরো ফুট নিচে লাফ দিয়ে পড়ি। তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা বৃষ্টির মধ্যে দৌড় দিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি। পাকিস্তানী সেনারা পেছন থেকে আমাদের গুলি করতে থাকে। আমরা কয়েকজন পালিয়ে নিজেদের রক্ষা করলেও ওই ট্রেনের প্রায় ৪১৩ জন যাত্রী শহীদ হন।’
ট্রেনের দ্বিতীয় বগি থেকে পঞ্চাশ জনের মতো জীবনবাজি রেখে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সেনারা তাদের লাফিয়ে পড়তে দেখে পেছন থেকে ব্রাশফায়ার করতে থাকে। ব্রাশ ফায়ারের হাত থেকে তেইশজনের মতো বেঁচে যান। বাকি সবাইকে পাকিস্তানী সেনারা ট্রেন থেকে নামিয়ে বিহারীদের সহযোগিতায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে।
পাকিস্তানী সেনারা শিশুদের আকাশে ছুড়ে তরবারির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে দ্বিখ-িত করে হত্যা করে। অনেক শিশুকে পাকিস্তানী সেনারা এক পা দিয়ে অন্য পা টেনে ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করেছে। ওই দিনের গণহত্যায় নারী ও শিশুরা বেশি ধর্ষিত ও শহীদ হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল ভারত। তবুও সব ইতিহাস ভুলে গিয়ে আজকের দিনে কিছু বাংলাদেশিরা পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে সাপোর্ট করে, যেটা ভারতবর্ষের কাছে খুবই দুঃখের।
Your email address will not be published. Required fields are marked *